Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ইচ্ছেমত ভন্ডুল কর

আরে বাবা, একটা লোক যখন খেলছে, তার কাছে আসল জিনিস হল খেলে যাওয়া। ড্রেসিংরুমে চলুক না অন্যায়, বিপন্ন হোক না দেশের ক্রিকেট।ওরে ভাই, আমি রাজার রাজা! যখন খেলেছি, সারা পৃথিবী মাথা ঝুঁকিয়ে চরণামৃত চেটে কোরাসে বলেছে, শ্রেষ্ঠ! বেস্টো! ডন ব্র্যাডম্যান পাশে বসিয়ে পিঠ চাপড়েছে। ফ্যানেরা চেয়েছে টিমের একটা উইকেট পড়ে যাক, আমার আগের লোকটা আউট হোক, যাতে আমি নেমে পড়তে পারি। যে দিন রিটায়ার করলাম, খেলার শেষে মাইকের সামনে ফেয়ারওয়েল-চিঠি পড়ছি, আর গোটা ভারত ইমোশনাল ডায়েরিয়া-য় হাপুস অশ্রু ওগরাচ্ছে।

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

ওরে ভাই, আমি রাজার রাজা! যখন খেলেছি, সারা পৃথিবী মাথা ঝুঁকিয়ে চরণামৃত চেটে কোরাসে বলেছে, শ্রেষ্ঠ! বেস্টো! ডন ব্র্যাডম্যান পাশে বসিয়ে পিঠ চাপড়েছে। ফ্যানেরা চেয়েছে টিমের একটা উইকেট পড়ে যাক, আমার আগের লোকটা আউট হোক, যাতে আমি নেমে পড়তে পারি। যে দিন রিটায়ার করলাম, খেলার শেষে মাইকের সামনে ফেয়ারওয়েল-চিঠি পড়ছি, আর গোটা ভারত ইমোশনাল ডায়েরিয়া-য় হাপুস অশ্রু ওগরাচ্ছে। স্টেডিয়ামে তো চোখের জলে পিচ ভেসে যাওয়ার জোগাড়। পরের দিন খেলা হলে এক্সট্রা সপার লাগত।

খেলা ছেড়ে দিলেও, নিউজ তো ছাড়তে পারি না, কোটি মানুষের মনোযোগের সেন্টারে থাকা অভ্যেস। তাই এ বার বের করেছি আত্মজীবনী। তার আবার একটা চোখা খরখরে টুকরো কায়দা করে ছেড়ে দিয়েছি অ্যাডভান্স। তাতে চ্যাপেলের গুষ্টির তুষ্টি। ব্যস, অব্যর্থ লাগভেলকিলাগ! মিডিয়া খাবলে সেটাকে ব্রেকিং নিউজ করে আছড়াচ্ছে, জনতা হামলে খাচ্ছে চাটছে হাঁইহাঁই জাবর কাটছে। একেই চ্যাপেলকে সবাই ঘেন্না করতে হেভি ভালবাসে। তার নামে নয়া গালাগাল আর পড়তে পায়! আমার বই বিক্কিরি হতই অযুত নিযুত, এ বার টাকা রাখতে ব্যাংকে স্পেশাল ভল্ট বানাতে হবে।

চ্যাপেল বলেছে, আমি যা বলেছি, সব মিথ্যে। আমি বলছি, চ্যাপেল যা বলছে সব মিথ্যে। এ বার, ভারত কাকে বিশ্বাস করবে? অব কোর্স আমাকে! আমি ওদের ভগবান। ঈশ্বর কখনও গুল মারে? তা ছাড়া আমি তো হাতে হাতে প্রমাণ দিচ্ছি। চ্যাপেল যে আমাকে এসে বলেছে, দ্রাবিড় হটাও, তুমি আর আমি মিলে ক্রিকেট শাসন করব, কী প্রমাণ? কেন, আমার বউ পাশে বসেছিল। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হয়? নিশ্চয় আমার খাতিরে আমার বউ মিথ্যে বলতে রাজি হবে না! তাই প্রুভ্ড, চ্যাপেল ভিলেন। চ্যাপেল কেন ওর বউকে নিয়ে আসেনি? আমি তো বারণ করিনি।

দ্রাবিড় আবার বেশি পাকা। বলেছে, এ সব নিয়ে ওর কোনও ইন্টারেস্ট নেই। বরং ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে আমি কী লিখেছি, তাতে ও উত্‌সাহী। আহাহা রে, স্টুডিয়াস ছাত্তর আমার, ব্যাটসম্যানশিপ শিখে ও বোধহয় অ্যাদ্দিনে বুঝবে, কখন ডিক্লেয়ার দিতে হয়! আরে, বইয়ে ছম্মকছাল্লু কন্ট্রোভার্সি না লিখে আমি কি কপিবুক ম্যানুয়াল রগড়াব? লোকে হাঁড়ির খবর পেতে চায়। কার সঙ্গে কার ঝগড়া, কার সঙ্গে কার ভাব, কে আমাকে ঘুষ দিতে চাইছিল, কে বেটিং করতে বলেছিল। এ সব ঘরানার গসিপ না লিখে স্কোয়ার কাট মারার আদর্শ প্রণালী কপচালে বই বিক্কিরি হবে? বইয়ের খেলাও খেলতে জানতে হয়।

উলটো দিকে ভাজ্জিকে দ্যাখো। কেন, লক্ষ্মণও। কী স্মার্ট! সব্বাই আমার সাপোর্টে এগিয়ে এসেছে। গাঙ্গুলির কথা তো বাদই দিলাম। ও তো সবচেয়ে ভিকটিম। সবাই বলেছে, চ্যাপেল হাড়ে হাড়ে বদমাশ, মহা পাজি। সবাইকে অপমান করত, একে-তাকে বাদ দিতে চাইত। পেছন থেকে ছুরি মারত। একটা লোক যাচ্ছেতাই খারাপ, এ কথা যদি অনেকে বলে, তা হলেই কি নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ হয়ে যায় না, তার নামে সব অভিযোগই সত্যি? পাড়ার মধুবাবু রোজ মাতাল হয়ে ফেরেন, এই কথা জানলে কি সহজেই নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, উনিই বারান্দা থেকে আঁকশি দিয়ে বিনিপিসির থান চুরি করেছেন?

কতকগুলো আবার বিশ্বনিন্দুক চোখে-আঙুল-দাদা আছে, তারা চিল্লাচ্ছে: এ সব কথা এখন বলার কী মানে? চ্যাপেল যদি এত খারাপ ছিল, তা হলে তার বিরুদ্ধে তখন এই প্লেয়ারশ্রেষ্ঠ প্রতিবাদ করেনি কেন? হ্যঁা, প্রতিবাদ করি আর টিম থেকে কাঁচি হয়ে যাই আর কী। আর তোমরা নাকে কান্না কেঁদে একখান বাঁটকুল শহিদ বেদি গড়ে দাও, আমি তার মধ্যে দুমড়ে, গুমরে গুমরে মরি। আরে বাবা, একটা লোক যখন খেলছে, তার কাছে আসল জিনিস হল খেলে যাওয়া। ড্রেসিংরুমে চলুক না অন্যায়, বিচ্ছিরি ও অযৌক্তিক ভাবে বাদ পড়ুক না কমরেডরা, অপমান খাক না প্রিয় বন্ধুর দল, বিপন্ন হোক না দেশের ক্রিকেট, অবিশ্বাসে আর ঝগড়ায় সতেরো ভাগ হয়ে যাক না টিম, বিশ্বকাপ যাক না হাতের পাঞ্জা গলে বহু মাইল ফসকে। আমি খামকা মসিহা হয়ে তরোয়াল নিয়ে লাফাতে যাব কেন? বিপ্লব করতে তো আসিনি, ক্রিকেট খেলতে এসেছি। সততার দাম নিশ্চয় কেরিয়ারের চেয়ে বড় নয়? গোঁড়াগাম্বু নীতি-আঁকড়া হতে গিয়ে আমি নিশ্চয়ই রেকর্ড খ্যাতি পুরস্কার হাততালি আর আইকন-পুজোর শিয়োর ক্যাচটা হাত থেকে স্লিপ করে যেতে দেব না?

ও সব ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে...’ গেধো লোক কহে। ঝাড়ের সময়ে টুক করে অন্যায় সয়ে যেতে হয়। একে বলে নম্র ব্যবহার। সত্যিকারের জেন্টলম্যান কে? যে কক্ষনও সাতে-পাঁচে-পঁয়ত্রিশে থাকে না, বিতর্ক ‘ডাক’ করে এড়ায়, প্যঁাচোয়া প্রশ্ন শুনে পূর্ণ চেপে যায়। শুধু নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করে চলে। আমার নামে কেউ ফোঁট্টাও কালির ছিটে লাগাতে পেরেছে? কোনও স্ক্যান্ডাল, কোনও বদমেজাজের কমপ্লেন? নেভার। আমি সত্যিকারের নির্বিরোধী জিনিয়াস, পাশের গলিতে খুন হলে কানে ওয়াকম্যান দিয়ে নেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত থাকা ধ্যানী।

তা হলে এখন সে স্বভাবের মশারি ছেড়ে বাইরে হল্লা মচাচ্ছি কেন? যাব্বাবা, এখন যে আমি অ্যাগ্রেসিভ সত্‌! এখন যে আমি মুখোশ খুলে দেওয়ার তুমুল কাণ্ডারী! আমার যে আর স্টেক নেই। কেরিয়ার শেষ, মন্দির প্রতিষ্ঠিত, মাথার পেছনে জ্যোতিগোল্লা দৃৃঢ় পেরেকে ফিট। এখন ঝুঁকিহীন ভাবে আমি সমাজ শোধরাব। সব ব্যাটার ঝুলি থেকে বলে বলে ক্রাইম-বেড়াল বের করব। আর মুচকি হেসে লাল-পড়া ভক্তকুলকে ভনব, ওরে পাগলার দল, পশ্য, ক্রিকেটেও দশে দশ, বই লিখলেও বেস্টসেলারের যশ!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE