Advertisement
০৩ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ইতি হ আস

ভারত মানে যে কম্বুকণ্ঠে উদ্গাত গায়ত্রী মার্গটুকু নয়, এই ভূখণ্ড মানে যে আরও আরও আখ্যান, অ-বৈদিকের নারীর শূদ্রের অন্ত্যজের, লোকের ও লোকায়তের, সঙ্ঘ পরিবারের ‘ইতিহাস’ সেই সত্যকে অস্বীকার করে। ঈপ্সিতা হালদারসম্প্রতি ‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস’-এর প্রধান দিননাথ বাত্রা মহোদয় স্থির করেছেন, সিবিএসই স্কুলগুলিতে সংস্কৃত সপ্তাহ পালন করতে হবে। সেখানে বিদেশি ভাষা, জার্মান-ফরাসি-স্প্যানিশ-চিনা ভাষার সঙ্গে অপশনাল হিসেবে সংস্কৃত আছে দেখে খুব ক্ষিপ্ত তিনি, কারণ এই যেমন, জার্মান ভাষা শিখে কী হয়, না, ম্যাক্স মুলার ভবনের পয়সায় বাচ্চারা জার্মানি বেড়াতে যায়।

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সম্প্রতি ‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস’-এর প্রধান দিননাথ বাত্রা মহোদয় স্থির করেছেন, সিবিএসই স্কুলগুলিতে সংস্কৃত সপ্তাহ পালন করতে হবে। সেখানে বিদেশি ভাষা, জার্মান-ফরাসি-স্প্যানিশ-চিনা ভাষার সঙ্গে অপশনাল হিসেবে সংস্কৃত আছে দেখে খুব ক্ষিপ্ত তিনি, কারণ এই যেমন, জার্মান ভাষা শিখে কী হয়, না, ম্যাক্স মুলার ভবনের পয়সায় বাচ্চারা জার্মানি বেড়াতে যায়। ইত্যাকার ম্লেচ্ছপনা ঘুচিয়ে সেই কালের দিকে যাত্রা বাত্রাজির, তাই তাঁর নিদান, সংস্কৃত ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক হোক। তারই সূচনা এই দেবভাষা গৌরব সপ্তাহ পালন। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে বাত্রাজি পাঠিয়েছেন তেইশ পাতার নোট।

দিননাথ বাত্রার বয়স পঁচাশি, তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্কুলে পড়াতেন, গুজরাত সরকার রাজ্যের ৪২,০০০ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল লাইব্রেরিতে তাঁর লেখা নানান ইতিহাস বই রাখার এত্তেলা দিয়েছে। সেখানে গরুপুজো করলে বন্ধ্যা নারী পুত্র পায়, পুষ্পকবিমান মানে প্রথম এরোপ্লেন, যুদ্ধাস্ত্র প্রথম নিউক্লিয়ার বোমা, বৈদিক অঙ্কই একমাত্র অঙ্ক, ঋষিমুনিরা আদি বৈজ্ঞানিক। এই গ্রন্থমালার জন্য প্রকাশককে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এমনকী রাষ্ট্রের ম্যাপও ফিরে আঁকার নির্দেশ দিয়েছেন বাত্রাজি, যে ম্যাপ নাকি হিন্দু-ভারতকে দাগিয়ে তৈরি হবে, আফগানিস্তান পাকিস্তান তিব্বত নেপাল বাংলাদেশ সবে মিলিয়ে থাকবে ‘অখণ্ড ভারত’ নামক একটি ভূখণ্ড। ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপর বলেছেন, ইতিহাস নয়, এ হল ফ্যান্টাসি, যাঁদের শিশুরা এই ইতিহাস বই পড়বে, গুজরাতের সেই সব মানুষের অপমান এটা। ইরফান হাবিবের মতে, যুগপত্‌ রগড়ের আর আতঙ্কের এই বই।

স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিকে, নানা দৃষ্টিভঙ্গিকে টুঁটি টিপে যখন কর্তাভজা করে তোলার গোঁ চলে, এবং তা চলে একটি স্বাধীন বহুত্বকামী রাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষানীতির নামে, তখনই সংকট চূড়ান্ত হয়। ভারত মানে যে কম্বুকণ্ঠে পবিত্র সংস্কৃতে উদ্গাত গায়ত্রী মার্গটুকু নয়, এই ভূখণ্ড মানে যে আরও অনেকের আখ্যান অ-বৈদিকের নারীর শূদ্রের অন্ত্যজের, লোকের ও লোকায়তের, এই গোঁ-এর টঙ্কারে সেটা ক্রমে লোকে ভুলে যায়। লোক, মানে যারা পাবলিক, এমনিতে সংস্কৃত নিয়ে আকুলিবিকুলি করলেও আসলে বেদ উপনিষদ ছেড়ে দিলাম, বাল্মীকিরামায়ণ ব্যাসমহাভারত-এর দু’ছত্র না পড়েই জানে যে, ভারত মানে মুনি-ঋষি, যারা রিপুজয়ী, আর দেবতারা তো দ্যাবতাই, সেই পাব্লিক ‘হিঁদু’পতাকায় কী জানি ইয়ে পড়ল ভেবে খড়্গ ও ইটহস্ত হয়। সেই অদীক্ষিত চেতনা কী করে তৈরি হয়, কারা তৈরি করে, পোষে, সেটা মোটামুটি জানা।

এবং এও জানা যে, এর বাইরে একটা খোলা স্বাধীন জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র আছে, যেখানে শাস্ত্র-আখ্যান উভয়কেই ইতিহাসের আলো ফেলে দেখা হয়। তৈরি হয় ইতিহাসসচেতন তার্কিক মনন। গবেষকরা দেখান, ওই সংস্কৃতের মধ্যেই আছে ভূত, মার্গের মধ্যেই আছে লোকজ চেতনা, পরতে পরতে আছে তন্ত্রের গূঢ় কূট, সংকেতময় শরীরী প্রতীক। বা যেমনটা মানুষ আদিলগ্নে থাকত, যৌননিয়ম বিহীন, বৈদিক দেবতারাও তৈরি ছিলেন সেই ছাঁচে। তখন ওই মুক্তমনের গবেষকরা অনড় অচল গোঁড়া ধ্যানধারণাকে যেমন নাড়া দেন, প্রথাগত সাহিত্য, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব গড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেও প্রশ্ন তোলেন তেমনই। তখনই এই গেরুয়াসৌধে সবচেয়ে আঘাত লাগে আর একটা রাষ্ট্র শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রের তার্কিক সৃষ্টিশীলতাকে পায়ের নীচে পোকার মতো পিষে হিন্দু ধর্ম নামে একটি সত্য নির্মাণের মতলবে তার শিক্ষানীতি তৈরি করে। যদি কেউ দেখায় যে, না, ধর্ম জিনিসটা হল স্বতশ্চল, হিন্দু আর বৈদিক ধর্ম এক নয়, নানা সময়ে নানা শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়েছে, নানা লোক লোকায়ত মিলেছে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে, সংস্কৃতও প্রভাবিত করেছে লোকধর্মকে, সবে মিলে তৈরি হয়েছে ধর্মপ্রবণতা শরীর যৌনতা মরমিয়া সহজিয়া আর নান্দনিকতার এক জটিল ও স্বতঃস্ফূর্ত রূপ, তা হলেই রে-রে করে তেড়ে উঠে বাত্রাজিরা ঠুকে দেবেন কেস।

২০০৮ সালে বাত্রাজিদের চাপে দিল্লি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সিলেবাস থেকে এ কে রামানুজনের ‘থ্রি হানড্রেড রামায়ণাস: ফাইভ একজাম্পলস অ্যান্ড থ্রি থটস অন ট্রানস্লেশন’ প্রবন্ধটিকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কেননা, ওই প্রবন্ধ জানায়, কালে কালে, দেশে দেশে রামের কাহিনি বহু বার, বহু স্বরে, বহু কলমে ফিরে লেখা ও গাওয়া হয়েছে, আর তা থেকে দেশকালের ভিন্নতা ও নানা গোষ্ঠীর ও সংস্কৃতির নানা অভিপ্রায় বোঝা যায়। পুরোটাই রামায়ণ, রামায়ণ-সংস্কৃতি। কিন্তু না, বাত্রা-পতাকার আওতায় বাল্মীকি রামায়ণ সত্য, ইতিহাস একটাই। মহাকাব্য অর্থাত্‌ আখ্যানকে ইতিহাস বলে দাবি করায় গোঁয়ার্তুমি স্পষ্ট। সেই আখ্যানের মধ্যে থেকে কিছু কিছু জিনিস বেছে সেগুলোকে একমাত্র এক দিক থেকে দেখে সেটাই সত্য ঠাউরানোর চেষ্টাও আশ্চর্য। ভেবে দেখুন, যদি বাত্রাজির গোঁ অনুযায়ী বাল্মীকি রামায়ণ সত্য ঘটনাই হয়, তা হলে বেদ পড়ার জন্য যে রাম যে শম্বুকের জিভ কেটে নিলেন, সে নিয়ে রামের বিরুদ্ধে শূদ্রের ক্ষোভও সত্যি ও অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিতে হবে। সেখানেই বাত্রাজির অসুবিধে। কারণ, তাঁর ইতিহাস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেখানে রামজীউয়ের সাত খুন মাপ।

গত ফেব্রুয়ারিতে এক প্রকাশনা সংস্থা বাত্রাজির থেকে শমন পায়, তাদের ছাপা ওয়েন্ডি ডনিগার-এর ‘দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’র সব কপি নষ্ট করে ফেলতে হবে। কেননা, লেখক দেবদেবী শাস্ত্রমন্ত্র, বারব্রত, আচারবিচারকে দেখেছেন যৌনতার সাপেক্ষে, যাকে সাইকোঅ্যানালিসিস বলে। হিন্দু ধর্মকে বিকৃত করা হয়েছে, তার মহিমায় চুনকালি দিয়ে হিন্দুদের ধর্মীয় সংবেদনে ঘা দেওয়া হয়েছে বলে বাত্রাজির ক্ষোভ। কেননা, শিবলিঙ্গ প্রথার মধ্যে নিহিত যোগীর নির্বেদ এবং যৌনবোধ এই দুইই খুঁজে পেয়েছেন ওয়েন্ডি, যিনি এক জন প্রতিষ্ঠিত ভারততাত্ত্বিক। কেননা, মলাটে ছাপা হয়েছে, কৃষ্ণ প্রায়-নগ্নিকাদের সঙ্গে রাসলীলা করছেন যে কৃষ্ণ অনেক মন্দিরে পূজিত, তিনি এই সব গণযৌনাচার করবেন, এ হতে পারে না। কেননা লেখা হয়েছে যে, রামায়ণ-মহাভারত ঐতিহাসিক সত্য নয় আখ্যান। কেননা বলা হয়েছে, বেদ, পুরাণ, মহাকাব্যে নারী-শূদ্রের মূল অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে ধর্ষণ ধর্ষণই, এমনকী দেবতারা করলেও। কেননা, ওয়েন্ডি বলেছেন যে, হিন্দু ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে যতখানি বৈদিক ধর্মের উপর, ততখানিই প্রাক্ বৈদিক ও না-বৈদিকের উপর। ধর্ম ও ইতিহাসের যে নানা ব্যাখ্যা যে হয়, কোনও ইতিহাস যে একমাত্রিক নয়, এই প্রস্তাব পেড়েছেন ওয়েন্ডি। এই প্রস্তাব যে-কোনও গোঁড়া ধর্মবোধ এবং ধর্মতত্ত্বের বিরোধী। ওয়েন্ডি হিন্দু নন, বাইরের কেউ, ফলে তিনি কিছুই বুঝলেন না এই বলে তাঁকে অ-দীক্ষিত প্রমাণ করার চেষ্টা ততোধিক অ-দীক্ষিত। যিনি গবেষক, বিশেষজ্ঞ, তিনি বেদ-গীতা কম জানেন আর হিন্দুর ঘরে জন্মমাত্রে আমি সবটা জেনেবুঝে ফেললাম, আর সেই অনুযায়ী কেবলই আমার হিন্দু সংবেদনে আঘাত লাগতে থাকল এমন ঠুনকো হিন্দুত্ব থাকার চেয়ে খানখান করে ভেঙে যাওয়াই ভাল।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial ipsita halder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE