Advertisement
E-Paper

উদ্ভাবনা না খুঁজে পাওয়া

সময়ে ভেসে শিল্পের যে ক’টি নৌকা শেষ পর্যন্ত একুশ শতকে নোঙর করতে পারল, তাদের অন্যতম প্রধান জঁ-লুক গোদার। আজ তাঁর ৮৫তম জন্মদিন। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।প্রতিভা না চালাকি— এই প্রশ্ন পার হয়ে পৌত্তলিক আর নাস্তিক উভয় পক্ষই মেনে নিয়েছে যে গোদার আর নেহাত চলচ্চিত্রস্রষ্টা নন, বরং বিশ শতকের ইতিহাসে একটি সাংস্কৃতিক গ্রাফিতি, যেমন পিকাসো বা ব্রেশট্।

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০

প্রতিভা না চালাকি— এই প্রশ্ন পার হয়ে পৌত্তলিক আর নাস্তিক উভয় পক্ষই মেনে নিয়েছে যে গোদার আর নেহাত চলচ্চিত্রস্রষ্টা নন, বরং বিশ শতকের ইতিহাসে একটি সাংস্কৃতিক গ্রাফিতি, যেমন পিকাসো বা ব্রেশট্।

তাঁর শেষ নির্মাণ ‘আদিউ ও লাঁগাজ’ বা ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গোয়েজ’ সাম্প্রতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের অতিথি ছিল। ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড সীমান্তে যে গ্রামটিতে গোদার এখন থাকেন, সেখানে দিনের কোনও কোনও সময় উচ্চারণের তারতম্যে স্থানীয় কথ্য ফরাসি ভাষায় ‘বিদায়’কে ‘স্বাগত’ সম্ভাষণ হিসেবে মেনে নেওয়ার রেওয়াজ চালু। যেমন আমাদের বাংলা ভাষায় বিদায়মুহূর্তে ‘আসি’ মানে আসলে ‘যাই’।

পৃথিবীতে আশি বছরেরও বেশি সময় কাটানোর পরে রবীন্দ্রনাথ ‘রূপ-নারানের কূলে’ জেগে উঠে বুঝেছিলেন শব্দ শুধু শব্দের অর্থে নিষিক্ত হতে পারে। চুরাশি বছরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে গোদার আবিষ্কার করেন অন্তঃসলিলা সেই যোগাযোগ। প্রকৃতি যেন এক মন্দির, মানুষ সেখানে আসে প্রতীকের অরণ্য পেরিয়ে। সেই ভাষা ‘নিশীথের মতো ব্যাপ্ত, স্বচ্ছতার মতো মহীয়ান!’ গোদারের মূল সংকট হচ্ছে ভাষার লিখিত রূপের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রামাণ্য হলেও, চলচ্চিত্রকারের ভাষা নিরূপায় ভাবে চিত্রধ্বনিময়। র্যাঁবো যে-ভাবে স্বরবর্ণের রং খোঁজেন, জয়েস যে ভাবে লেখেন, গোদার তা লক্ষ করে এক ধরনের ‘সাহিত্য-তা’ সিনেমায় জড়িয়ে নেওয়া যায় কি না, ১৯৬৫-র ‘পিয়েরো ল্যো ফু’ ছবিতে তা নিয়ে প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তারও আগে যৌবনারম্ভে তাঁর শিক্ষক ভাষা-দার্শনিক ব্রিস পারঁ’কে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিলেন, ‘চিহ্নই আমাদের বাধ্য করে অর্থদ্যোতনার মধ্য দিয়ে বস্তুকে দেখতে।’ তবু এই চিহ্নমালাও বদলায়, বদলে যেতে থাকে বিরতিহীন। মহাপ্রস্থানের পথে যে সারমেয়টি গোদারকে সঙ্গ দেয়, তার নগ্নতা প্রসঙ্গে স্রষ্টা দেখাতেও চান, ‘উলঙ্গ’ বিশেষণটির তাৎপর্য নর বা নারীর ক্ষেত্রে যা, কুকুর বা অন্যান্য মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে তা নয়। শব্দের সীমানা আছে, কৃত্রিমতাও আছে।

চলচ্চিত্রকার, জনশ্রুতি অনুযায়ী, বাস্তবকে শনাক্ত করতে পারেন। তাঁর আচার্য বাস্তববাদী তাত্ত্বিক আঁদ্রে বাজাঁ আলোকচিত্রের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে দাবি করেছিলেন, মূর্ত বাস্তবের প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা যতটা মানসিক, ততটা যৌক্তিক নয়। রেনেসাঁস-উত্তর পর্বে ইউরোপীয় প্রতিরূপায়ণে নকল করার প্রবৃত্তি দেখেই তাঁর মনে হয়েছিল ‘পরিপ্রেক্ষিতই পশ্চিমী চিত্রকলার আদি পাপ।’ এই পাপ যে কত দূর মর্মান্তিক, তার একটি উপযুক্ত দৃষ্টান্ত দিতেই হয়তো গোদার সংশ্লিষ্ট ছায়াছবিতে আরও স্পর্শগ্রাহ্য আয়তনের কথা ভেবেছেন। কারণ, ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গোয়েজ’ ত্রিমাত্রিক, তাতে ঘন বাস্তবতার স্বাদ। বলা চলে এক জন শিল্পীর পক্ষে এ ধরনের উদ্যোগ এক দার্শনিক ফিচলেমি। গোদার তো আর থ্রিডি বলতে দুর্ধর্ষ দানব অথবা শিশুতোষ প্রাসাদ বানাবেন না! তাঁর প্রিয় কবি আরাগঁর মতো তিনিও অনেকটাই বিশ্বাস করেন, কাব্যের (পড়ুন চলচ্চিত্রের) ইতিহাস শেষ পর্যন্ত তার টেকনিকের ইতিহাস, উপরন্তু সিনেমা বিশেষ ভাবেই প্রযুক্তিনির্ভর ভাষা। সুতরাং, গোদার পিছিয়ে আসেননি। অসমসাহসে আধুনিকতম প্রয়োগকৌশল রপ্ত করেছেন। যেমন ধরা যাক ছবিটির শেষের দিকে লো-অ্যাঙ্গল ট্র্যাকিং-এর কথা। টেবিলের কানা ও চেয়ারের পায়া লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাওয়ায় আমাদের ধাঁধা লাগে যে কী দেখব, কোথা থেকে দেখব। একটু পরে টেবিল পার হয়ে গেলে পরিপ্রেক্ষিত বোঝা যায়, যে ফোকাস আসলে দূরে আছে। এক বার ক্যামেরা প্যান করে গোদার একটি ত্রিমাত্রিক ইমেজকে দু’টি দ্বিমাত্রিক ইমেজের যোগফল হিসেবে দেখাতে চান। অর্থাৎ, গোদার একই সঙ্গে ত্রিমাত্রিক ফরম্যাট ব্যবহার করেন ও তাকে সন্দেহ করতে থাকেন। বস্তুত তিনি আমাদের দেখার সংস্কার পালটে দিতে চান। তবু তো কারিগর বা জাদুকর নন শুধু। যেখানে পুরুষ চরিত্রটি বিশ্বাস করে শূন্য আর অনন্ত মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, সেখানে নারী চরিত্রটি ভাবে যৌনতা আর মৃত্যু। কিন্তু একে আবিষ্কার হিসেবে উদ্ভাবনা বলব, না খুঁজে পাওয়া বলব?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক

post editorial sanjoy mukhopadhay sanjoy mukherjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy