ক্রিকেট হইতে মুদ্রা, শতকরা হিসাব হইতে উচ্চতর গণিত, বহু ক্ষেত্রেই ১০০ সংখ্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কোনও সরকারের প্রথম একশত দিনের ক্ষেত্রে অবশ্য ১০০ একটি সংখ্যামাত্র, তাহার অন্যতর মাহাত্ম্যের সন্ধান অনর্থক। তবুও, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম ১০০ দিন লইয়া চর্চা চলিতেছে। তাহার একটি কারণ যদি ১০০ সংখ্যাটির প্রতি মানুষের অহৈতুকী আকর্ষণ হয়, অন্য একটি কারণ বিজেপি-র নির্বাচনী প্রচার। একশত দিনের জন্য যতগুলি প্রতিশ্রুতি সেই প্রচারে ছিল, তাহার অনেকগুলিই অপূর্ণ রহিয়াছে। দোষ অবশ্য সরকারের নহে, দোষ প্রতিশ্রুতির। মূল্যস্ফীতি বা দুর্নীতির ন্যায় সমস্যা ১০০ দিনে মিটিবার নহে। কালো টাকা ফিরাইয়া আনিবার পক্ষেও সময়টি কম। কেহ বলিতে পারেন, ভাবিতে উচিত ছিল, প্রতিজ্ঞা যখন— কিন্তু সেই তর্ক থাকুক। এই সরকারের প্রথম একশত দিনের কৃতিত্ব বিশ্লেষণ করিয়া বলিতে সাধ হয়, ইহা তৃতীয় ইউপিএ সরকার। নীতিগত ভাবে ইউপিএ-র উত্তরাধিকার বহিতেছে, কিন্তু তুলনায় অনেকখানি সুশাসিত। এক জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার চরিত্রে খানিক রদবদল ভিন্ন ইউপিএ-র নীতিগুলি অব্যাহত আছে। খাদ্য নিরাপত্তা আইন বর্তমান, জন-ধন যোজনাও আধার প্রকল্পের সহিত সংযুক্ত। ভর্তুকির চরিত্রেও তেমন পরিবর্তন আসে নাই। এমনকী, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি বৃদ্ধির যে নির্বাচনমুখী সিদ্ধান্ত ইউপিএ লইয়াছিল, তাহাও বহাল আছে।
দক্ষ ভাবে, সুপ্রশাসনের মাধ্যমে ইউপিএ-র উত্তরাধিকার বহিবার জন্য ভারতবাসী নরেন্দ্র মোদীকে এমন ঐতিহাসিক জনমত দেন নাই। সত্য, নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখিবার গুরুত্ব আছে। এ কথাও ঠিক যে প্রথম একশত দিনেই নরেন্দ্র মোদী কিছু সাহসী পদক্ষেপ করিয়াছেন। যোজনা কমিশনের ঝাঁপ গুটাইয়া দেওয়া অথবা কারণে-অকারণে মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি করিয়া কালক্ষেপ করিবার প্রচলিত অভ্যাস ত্যাগ করা তাহার উদাহরণ। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কটিকে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পথে খানিক দূর হইলেও আগাইয়া দেওয়াও একটি বড় কাজ। বিদেশ নীতিতেও স্পষ্ট পরিবর্তন আসিয়াছে। কিন্তু, তাঁহার নিকট প্রত্যাশা অনেক। শিল্পে লাইসেন্স রাজ বিলোপ বা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দরজা খুলিয়া দেওয়ার মতো সংস্কারের সহিত নরেন্দ্র মোদীর নিকট প্রত্যাশিত শ্রম আইন সংস্কার বা জমি অধিগ্রহণের শিল্পসম্মত নীতি নির্ধারণের কাজগুলির পার্থক্য অনস্বীকার্য— দ্বিতীয় গোত্রের কাজগুলি অনেক কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন পথে হাঁটাই তো তাঁহার প্রতিশ্রুতি ছিল। খাদ্য নিরাপত্তা আইন আদৌ কেন থাকিবে, অথবা পণ্য ও পরিষেবা কর বা প্রত্যক্ষ কর বিধি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দ্রুত হইবে না কেন, এই প্রশ্নগুলি উঠিবেই।
প্রথম একশত দিন এখন অতীত। অতঃপর মোদীর কর্তব্য স্পষ্ট রাজকোষের ভারসাম্য বজায় রাখিতে হইবে, বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে। সরকারের প্রথম তিন মাসেই রাজকোষ ঘাটতি বৎসরের লক্ষ্যসীমার ৬০ শতাংশ অতিক্রম করিয়াছে। ভর্তুকির পরিমাণও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বাড়িতে পারে। এগুলি সুসংবাদ নহে। অন্য দিকে, মাল্টি ব্র্যান্ড রিটেল-এর ক্ষেত্রে সরকার এখনও নিরুত্তর। যত দ্রুত সম্ভব, এই দিকগুলিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন। মনমোহন জমানার সহিত নিজেদের তুলনা করিয়া আত্মতুষ্টিতে ভুগিবার ভুলটি বর্জনীয়। এবং, সরকারের আর্থিক নীতি কী, তাহা স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা বিধেয়। মোদী বা জেটলির মনে থাকাই যথেষ্ট নহে, নীতিগুলি জনসমক্ষে থাকা বিধেয়। এই স্বচ্ছতার অভাব ১০০ দিনে বড়ই প্রকট হইয়াছে।