ছবি: দেবাশিস বিশ্বাস
যে রাস্তায় বড়জোর দশ-বারো জন যাতায়াত করতে পারেন, সেখানে ফুলেফেঁপে, গায়ে গায়ে সেঁটে থাকবে পাঁচ-সাতশো জনের ভিড়। দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতেও উল্টো দিকের লোকগুলিকে নেমে আসার রাস্তা করে দিতে হবে। ভোর চারটেয় যে জায়গা পেরোতে আধ ঘন্টা লাগার কথা, সেখানে ঠেসাঠেসি করে ঘন্টা দুয়েক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। অক্সিজেনের অভাব, শ্বাসকষ্টও বিচিত্র নয়।
জায়গাটার নাম হিলারি স্টেপ। উচ্চতা ২৮,৭৪০ ফুট। সামনে ৪০ ফুট পাথরের খাড়া দেওয়াল। এটার ওপরে কোনও ক্রমে পৌঁছলে নিশ্চিন্তি। তার পর আলগা পাথুরে জমিতে এঁকেবেঁকে হাঁটতে হাঁটতে ট্র্যাভার্স করতে পারলেই পায়ের নীচে পৃথিবীর উচ্চতম ভূমি। ২৯,০২৮ ফুট। মাউন্ট এভারেস্ট। তার আগে এটাই শেষ চ্যালেঞ্জ!
গত দু’বছর যাবত্ মানুষের ভিড় জট পাকাচ্ছে নগাধিরাজের এই চ্যালেঞ্জ-স্পটেই। ধনী-নির্ধন, অজ্ঞ-অভিজ্ঞ সবাই এভারেস্টে পা রাখতে চায়। তেনজিং-হিলারির পর গত ৬১ বছরে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি বার ওই শিখরে মানুষের পা পড়েছে। তার দশ শতাংশই গত বছর। ৬৫৮ জন এভারেস্ট শৃঙ্গে পা রেখেছিলেন ২০১৩’য়। অন্য দিকে, পঞ্চাশের দশকে প্রথম জয়ের পর এখনও অবধি দ্বিতীয় উচ্চতম কে টু-র শিখরে পা রেখেছেন ৩৭৭ জন। তৃতীয় কাঞ্চনজঙ্ঘায় ১৮৭ জন। অন্নপূর্ণায় ১৩০। আর নাঙ্গা পর্বতে ২৬৩। উচ্চতম শিখর এখন জনপ্রিয়তম, সহজতম সবই। হিলারি স্টেপের ভিড় তারই মাসুল গুনছে।
এটা কলির সন্ধে। গত বছর এভারেস্ট অভিযানে ৮ জন মারা গিয়েছিলেন। এঁদের কেউ কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ করে ফেলেছিলেন। নেপাল জানিয়েছে, এ সমস্যা আর থাকবে না। হিলারি স্টেপে ধাতব মই লাগিয়ে দেওয়া হবে। দ্রুত ওঠানামা করা যাবে, সময় নষ্ট হবে না।
হিলারি স্টেপে মই? ভদ্রলোক কবরে পাশ ফিরে শোবেন। স্মৃতিকথায় লিখে গিয়েছেন, ‘মনে হল, সাফল্য ও ব্যর্থতার তফাত করে দেওয়ার জন্যই যেন দাঁড়িয়ে আছে এই দেওয়াল।’ অতঃপর এক চিলতে খাঁজে প্রথমে হাত, পা, দুই কাঁধ গলিয়ে দেওয়া। আস্তে আস্তে উঠতে থাকলেন এডমন্ড হিলারি। দড়ি ধরে টেনে তুললেন তেনজিংকেও! প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ জেতার সাহস আর দক্ষতা দেখিয়েছিলেন বলেই জায়গাটা আজ তাঁর নামে: হিলারি স্টেপ।
পর্বতারোহীরা ব্লগে, ব্যক্তিগত আড্ডায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এক, ওখানে মই লাগানো ইতিহাসের অসম্মান, মানুষের দক্ষতা ও সাহসকে অসম্মান। দুই, শেরপারা ওখানে ফিক্সড রোপ লাগিয়ে দেন। তার পাশে আর একটা মই অবান্তর। বরং দড়ি ধরে নামা সহজ। মই রাখলে হুড়োহুড়ি ও দুর্ঘটনা বাড়বে। তিন, এভারেস্টের উত্তর দিক দিয়ে ওঠার পথে অনেক দিন ধরেই ধাতব মই লাগিয়ে রেখেছে চিন, তবু ৬৮০০ এভারেস্ট অভিযানের বড় অংশটাই হয়েছে নেপাল দিয়ে। চিনের দিক থেকে তুলনায় কম, ২৪৫৫টি।
এঁরা বলছেন, ভিড়ের কারণটা আগে দেখতে হবে। এখন অ্যাডভান্সড ক্যাম্পে শেরপারা জিপিআরএস মোবাইলে জেনে যান, কোন দিন চুড়োয় ওঠার জন্য আবহাওয়া পরিষ্কার থাকবে। ওই দিনগুলিতেই ভিড় আছড়ে পড়ে। অতএব, অভিযানের যথেচ্ছ পারমিট বন্ধ হোক!
শুনতে ভাল। কিন্তু পর্বতারোহণের যুক্তিতে একটা গরিব দেশে (মানব উন্নয়ন সূচকে নেপাল ১৮৭টি দেশের মধ্যে ১৫৭তম) অর্থনীতির চিড়ে ভিজবে না। এভারেস্ট অভিযানে এখন ২৫ হাজার ডলারের ‘পিক ফি’ দিতে হয়। আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য জন্য টিম প্রতি ৪ হাজার ডলার, প্রতি টিমের জন্য এক জন লিয়াজোঁ অফিসার। তাঁর ফি ২৫০০ ডলার। ৬ সপ্তাহের জন্য রাঁধুনি ৫ হাজার ডলার। এক জন ক্লাইম্বিং শেরপা: ৫ হাজার ডলার। ১টি অক্সিজেন সিলিন্ডার: ৫০০ ডলার (মাথাপিছু ৪-৫টি সিলিন্ডার দরকার)। এভারেস্ট উচ্চতম ও জনপ্রিয় পর্বতশিখরই নয়, নেপালের ডলার অর্জনের বৃহত্তম ‘এস ই জেড’।
আগে অন্য রকম ছিল। শৃঙ্গজয় মানেই তখন যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি। ১৯৫৩ সালে তেনজিং, হিলারিদের দলে অভিযাত্রীরা ছাড়াও ছিলেন ৩৬২ জন পোর্টার আর ২০ জন শেরপা। সাড়ে চার হাজার কেজির বেশি মালপত্র। এখন শুধু ডলার থাকলেই হল। কুক, শেরপা, অক্সিজেন, টেন্ট সবই বন্দোবস্ত করে দেবে এজেন্সি। আশির দশকে নেপালই এই পদ্ধতি শুরু করে। অতঃপর? আজকের এভারেস্ট অভিযানে ৯০ শতাংশই ক্লাইম্বিং গাইডদের সঙ্গে। তেনজিং নোরগের ছেলে, এভারেস্টজয়ী জামলিং তেনজিং নোরগের জিজ্ঞাসা, ‘এটা অ্যাডভেঞ্চার নাকি? ৭০/৮০ হাজার ডলার খরচ করে যে কেউ এভারেস্টে উঠে যাচ্ছেন। এঁরা স্বার্থপর তো বটেই, অন্যদের জীবনও বিপন্ন করছেন।’
২০১৩ সাল এই স্বার্থপরতার অন্যতম প্রমাণ। সিজনের আগে, মার্চ মাসেই এভারেস্টে ডাক্তাররা চলে আসেন। এঁরা শেরপা, পোশাকি নাম ‘আইস্ফল ডক্টর’। অভিযানের পথে খুম্বু গ্লেসিয়ারে সবসময় বড় বড় হিমবাহের চাঁই ভেঙে পড়ছে, হিমবাহটিও নড়ছে। সিজ্ন শুরুর আগে এঁরাই সারা পথে অভিযাত্রীদের জন্য ফিক্সড রোপ লাগান, ক্রিভাস বা বরফের গর্তের ওপর ল্যাডার পেতে দেন। গত বছর ২৭ এপ্রিল দু’নম্বর ক্যাম্পে ওঁরা এ ভাবেই কাজ করছিলেন, তার আগে কারও এগনো বারণ। এক দল ইউরোপীয় অভিযাত্রী তবু এলেন। ওঁরা আগে শিখরে পৌঁছবেন। সাইমন মোরো নামে এক ইউরোপীয় পর্বতারোহী মিংমা নামে এক শেরপাকে গালিগালাজ করতে থাকেন, ‘আমাদের এখনই যেতে দে। অমুকের বাচ্চা, কত ডলার এক্সট্রা নিবি?’ মিংমাই প্রথম শেরপা, যিনি ৮০০০ মিটারের ওপরে দুনিয়ার ১৪টি শিখরেই পা রেখেছেন। শেষ অবধি মারপিট, রক্তারক্তি। তেনজিং আর হিলারির মধ্যে কে আগে শিখরে পা রেখেছিলেন, দুনিয়া জানতে পারেনি। এখন গালিগালাজ, মারপিট করেও আগে শিখর ছুঁতে হবে।
এক নম্বরকে ছোঁয়ার এই হুজুগে আদিখ্যেতাই পর্বতারোহণে জন্ম দিচ্ছে এক নতুন ভাষার। হিলারি স্টেপ, সাউথ কল, জেনেভা স্পার বহু দিন ধরেই বিখ্যাত। গাইডেড ক্লাইম্বিং তৈরি করেছে আরও সব নতুন নাম। খুম্বু গ্লেসিয়ার ছাড়িয়ে এক নম্বর ক্যাম্পে যেতে হলে রাস্তা জুড়ে এবড়োখেবড়ো বরফ। জায়গাটার নাম পপকর্ন। শিখর ছোঁয়ার পথে সাউথ কল ছাড়িয়ে চৌকো পাথুরে জায়গা। সেখানে সবাই অক্সিজেন সিলিন্ডার বদলায়, গলায় জল ঢালে। জায়গার নাম ব্যালকনি। দুনিয়ার আর কোনও পর্বতশিখরে এত পপকর্ন আর ব্যালকনি নেই।
সবই যুগের হাওয়া। পরিকাঠামো থেকে আদর, ভালবাসা সবই এক নম্বরের জন্য বরাদ্দ। অল্পের জন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় মানেই মূল্যহীন এবং অবজ্ঞাত। কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণারা কি এপ্রিল, মে-র সিজনে সাধে পাত্তা পায় না?
এক নম্বর নিয়ে এই হ্যাংলামি আগে ছিল না। এভারেস্টের শিখর ছুঁয়ে নেমে আসছেন হিলারি আর তেনজিং। টিমমেট জর্জ লোয়ি-র সঙ্গে দেখা। হিলারিই প্রথম আনন্দের খবরটা দিলেন, ‘ওয়েল জর্জ, উই নক্ড দ্য বাস্টার্ড অফ।’ যুদ্ধ জয়ের জোশ ছিল, অ্যাটিটিউড ছিল। স্বার্থপর, হুজুগে ভিড়ের চেয়ে ঢের ভাল, তাই না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy