Advertisement
E-Paper

ওষুধের বাজারে স্বাস্থ্য ফেরাতে পশ্চিমবঙ্গ মডেল

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতর সমস্ত রাজ্যকে অনুরোধ করেছে, যাতে পশ্চিমবঙ্গের ন্যায্যমূল্যে ওষুধ দেওয়ার প্রকল্প সবাই নিজের নিজের মতো করে চালু করে। বাংলা গত কাল যা ভেবেছে অন্য রাজ্যগুলি যদি কাল বা পরশু তা ভাবে, বহু মানুষ উপকৃত হবেন।এই রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ২০১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৯৩টি ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান খোলা হয়েছে। আরও ২৮টি কিছু দিনের মধ্যেই চালু হওয়ার কথা। এটি একটি সরকার বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ।

সুগত মারজিত্‌

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
পথপ্রদর্শক। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান, কলকাতা। ছবি: প্রদীপ আদক।

পথপ্রদর্শক। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান, কলকাতা। ছবি: প্রদীপ আদক।

এই রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ২০১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৯৩টি ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান খোলা হয়েছে। আরও ২৮টি কিছু দিনের মধ্যেই চালু হওয়ার কথা। এটি একটি সরকার বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ। এই দোকানগুলি কী ভাবে ওষুধের বাজার, মানুষের চিকিত্‌সার খরচ এবং সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের উপর প্রভাব বিস্তার করছে, সেটা বুঝতে গেলে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক সমস্যার ধারণা বোঝা দরকার। তার নাম: প্রাইস ডিসকভারি প্রবলেম। এর অর্থ, একটি জিনিসের যথাযথ দাম বা দামের বিভিন্ন উপাদানের মান কী হওয়া উচিত, সেটা বাজারে চালু দর থেকে উদ্ধার করা। এ ক্ষেত্রে সেই জিনিসটি হল ওষুধ, বা স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রাদি।

একটা ওষুধের দাম কত হওয়া ‘উচিত’, সেটা আমরা বাজার দর থেকে বুঝতে পারি না। ওষুধটি উত্‌পাদন ও বিপণন করতে যা খরচ হচ্ছে, তার উপরে কতটা মুনাফার হার চাপিয়ে তা বিক্রি করা হচ্ছে, তা জানার উপায় আমাদের হাতে নেই। এ বার, কাল যে ওষুধ আপনি একশো টাকায় কিনেছেন, আজ যদি তা পঁয়ত্রিশ টাকায় কিনতে পারেন এবং তাতে বিক্রেতার গণেশ না ওলটায়, তা হলে আপনার মনে এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে, পঁয়ত্রিশ টাকার ওষুধ কেন আপনাকে একশো টাকায় কিনতে হচ্ছিল? ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান এই প্রশ্নটিরই জন্ম দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারি হিসেবে, ক্রেতারা শতকরা ৪৮ থেকে ৬৭ ভাগ ছাড়ে তালিকাভুক্ত ওষুধ কিনতে পারছেন।

স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫টি ন্যায্যমূল্যের দোকান মারফত পরিষেবা পেয়েছেন ৯০ লক্ষ মানুষ। সব মিলিয়ে বিক্রি হয়েছে চারশো কোটি টাকার বেশি ওষুধ। দাম ছাড় দেওয়া হয়েছে আড়াইশো কোটি টাকার মতো। সরকারি হাসপাতালে পেসমেকারের দাম সম্পর্কিত যে তথ্য জনস্বার্থে প্রকাশ করা হয়েছে, তা থেকে দেখেছি, সবচেয়ে সাধারণ যন্ত্রটির ক্ষেত্রে এমআরপি’র চেয়ে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে দাম প্রায় ৭০ শতাংশ কম, সর্বোচ্চ মানের যন্ত্রের ক্ষেত্রে ফারাক প্রায় ৬০ শতাংশ। কোনও পণ্যের উত্‌পাদন ব্যয় ও বাজার দরের মধ্যে অনেকগুলো স্তর থাকে, স্তরে স্তরে দামের ফারাক হতে থাকে, এ আমরা জানি। কিন্তু সেই ফারাকটা কোথায় পৌঁছতে পারে, সেটা অনেক সময় আমাদের কল্পনার অতীত।

সরকার ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে অনেক সময় সমালোচনা করে বলা হয় যে, এর ফলে ওষুধ কোম্পানির মুনাফা কমে যায়, ফলে গবেষণায় বিনিয়োগ নিরুত্‌সাহ হয়। কিন্তু ন্যায্যমূল্যের দোকানের বিরুদ্ধে সেই সমালোচনা টিকবে না, কারণ বেসরকারি কোম্পানিই এই উদ্যোগে শরিক হচ্ছে এবং লাভ করছে। সচরাচর আমরা এফিশিয়েন্সি বা (বাণিজ্যিক) কুশলতার সঙ্গে ওয়েলফেয়ার বা কল্যাণের সংঘাত দেখি। এটা তার এক স্বাস্থ্যকর ব্যতিক্রম।

এই ব্যবস্থার ফলে হাসপাতালের বাইরের বাজারে ওষুধের দাম কমেছে। কিছু পরিচিত এবং নামী কোম্পানি এই ধরনের ওষুধের দোকান খুলেছেন। তাঁদের হিসেব অনুযায়ী, বাইরের খুচরো দোকানগুলিতে ২৫ শতাংশ মতো বিক্রি কমেছে। অনেক জায়গায় ওষুধের দামে দশ থেকে পনেরো শতাংশ ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। লক্ষ করার বিষয়, ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো অহোরাত্র খোলা থাকে। ফলে, যে সব বেসরকারি ওষুধের দোকান চব্বিশ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়, তারাও এই ব্যবস্থার ফলে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে, এতে ক্রেতাদের আরও বেশি সুবিধে হয়েছে। পাশাপাশি, ওষুধের গুণমান যাচাইয়ের জন্য অনলাইন তদারকির উদ্যোগ হয়েছে। এই আধুনিকীকরণের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও কায়েমি স্বার্থের প্রতিরোধ দেখা গিয়েছিল, তা অনেকাংশে দূর করা গেছে।

অর্থনীতি শিখিয়েছে, প্রতিযোগিতা সমাজের পক্ষে এক কল্যাণকর ব্যাপার। প্রতিযোগিতার ফলে দাম কমে। ভারতে এখন উন্নত দেশগুলির মডেলে একটি কম্পিটিশন কমিশন বসানো হয়েছে। পশ্চিমী দেশগুলিতে এই ধরনের কমিশনের কাজ পণ্যের দাম প্রতিযোগিতা-নির্ধারিত দামের চেয়ে কতটা বেশি, তা দেখা। ভারতে খুচরো বাজারে এ কাজ খুব জরুরি। আশা করা যায়, ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানগুলি প্রতিযোগিতা কমিশনের সাহায্যে আসবে।

স্বাস্থ্য দফতরের আর একটি সংযোজন: প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধের নাম লেখার প্রস্তাব। আমরা প্রশ্নটা যতই এড়ানোর চেষ্টা করি, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চিকিত্‌সকদের সম্পর্কের ছায়া প্রেসক্রিপশনে পড়েই। জেনেরিক ওষুধের নাম লেখার নিয়ম এই সমস্যার মোকাবিলায় কার্যকর। জেনেরিক ওষুধের দামে ছাড় দেওয়ার সুযোগও বেশি।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতর সমস্ত রাজ্যকে অনুরোধ করেছে, যাতে পশ্চিমবঙ্গের ফেয়ার প্রাইস মেডিসিন শপ প্রকল্পটি সবাই নিজের নিজের মতো করে চালু করে। বাংলা গত কাল যা ভেবেছে অন্য রাজ্যগুলি যদি আগামী কাল তা ভাবে, তবে পশ্চিমবঙ্গের হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবেন, তার উপরে ওষুধের বাজারদরে প্রভাব পড়লে পরোক্ষ উপকার হবে আরও বহু মানুষের। মনে রাখা দরকার, ভারতে স্বাস্থ্য খাতে খরচের বড় অংশ হচ্ছে ওষুধ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দাম। তাই এ উদ্যোগের সুফল সুদূরপ্রসারী।

ঋণ: ‘আর্লি উইদ্ড্রয়াল অব পেটেন্টেড ড্রাগস অ্যাজ অ্যান এনট্রি ডেটারিং ডিভাইস’, সুগত মারজিত্‌, তরুণ কবিরাজ এবং অরিজিতা দত্ত, ইমার্জিং ইস্যুজ ইন ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট, এস মারজিত্‌ এবং এম রাজীব সম্পাদিত (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৪)।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইল সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ

post editorial sugato marjit
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy