রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সংসদের যৌথ অধিবেশনে যে ভাষণ দিয়াছেন, তাহার কেন্দ্রস্থলে আছে অর্থনীতি। ধর্মনিরপেক্ষতা নহে, সর্বজনীন বৃদ্ধির চেনা এবং ফাঁকা বুলি নহে, আর্থিক উন্নয়নের পরিকল্পনা। রাষ্ট্রপতির সংসদীয় ভাষণ, স্বভাবতই, সরকারের মানসজগতের প্রতিফলক। ‘সরকার’ কথাটি বহুলাংশে গৌরবার্থে ব্যবহৃত— নরেন্দ্র মোদী যাহা ভাবেন, দেশ নির্মাণের প্রকল্পটিকে যে ভাবে দেখেন, এই ভাষণ তাহার রূপরেখা আঁকিয়াছে। সেই রূপরেখা তাঁহার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সহিত সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যাহা করা প্রয়োজন, এই ভাষণে সেই পথের উল্লেখ স্পষ্ট। তাহার মধ্যে যেমন দেশব্যাপী ইন্টারনেটের বিস্তারের কথা আছে, তেমনই জাতীয় সেচ নীতির কথাও আছে, জাতীয় জমি ব্যবহার নীতির প্রসঙ্গ আছে। রাষ্ট্রপতির ভাষণ সূচনামাত্র, তাহাকে সেটুকু গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়। কিন্তু, কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা যেমন এই ভাষণকে নেহাতই ‘কথার কথা’ বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছেন, তাহাও অনর্থক বিরোধিতা। ভারতীয় অর্থনীতি আজ যেখানে দাঁড়াইয়া আছে, সেই স্তর ছাপাইয়া যদি সত্যই উন্নয়নের উচ্চতর কক্ষপথে পৌঁছাইতে হয়, তবে বড় করিয়া ভাবিতে জানা জরুরি। বড় ছবিটি দেখিতে শেখা জরুরি। রাষ্ট্রপতির ভাষণে সেই বড় ছবিটির হদিশ পাওয়া যায়। এবং সেই কারণেই এই সূচনাকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব না দিলে মস্ত ভুল হইবে। উন্নয়নের পরম লগ্নটিকে চিনিতে না পারিবার ভুল। কংগ্রেস দশ বৎসর যে ভুল করিয়া আসিয়াছে।
উন্নয়ন যে সর্বজনীন হওয়াই বিধেয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ভর্তুকির ঝুলি খুলিয়া বসিয়া ‘সর্বজনীন উন্নয়ন’-এর ঢাক পিটাইলেই সেই কাজ হয় না। সরকারের কাজ মানুষের উন্নতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া দেওয়া, মাসে মাসে তাহার ঝুলিতে কিছু টাকা ভরিয়া দেওয়া নহে। উন্নয়নের জন্য এক দিকে বাহ্যিক পরিকাঠামো প্রয়োজন, অন্য দিকে সামাজিক পরিকাঠামোয় শান দেওয়া বিধেয়। শিল্প করিডর, বিনিয়োগ-অঞ্চল, দ্রুতগতির ট্রেন বা বিশ্বমানের বন্দর তৈরির কথা রাষ্ট্রপতির ভাষণে আছে। আবার, সমস্ত গ্রামে ইন্টারনেট পৌঁছাইয়া দেওয়া, জাতীয় বহুমুখী দক্ষতা মিশন, শ্রমনিবিড় শিল্পনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক পরিকাঠামোর দিকে নজর দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও আছে। তাঁহার সব কয়টি প্রতিশ্রুতি যে সমান সম্ভব বা সমান জরুরি, তাহা নহে। যেমন, ইউপিএ সরকারের ভ্রান্ত উচ্চশিক্ষা নীতি এই সরকারের ভাবনায় ছায়া ফেলিয়াছে। সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করিবার মতো টাকার জোর ভারতের আছে কি না, তাহাও তর্কসাপেক্ষ। সেই তর্কগুলি অবশ্যই চলিবে, এবং তাহার মাধ্যমেই নীতির অগ্রাধিকার নির্ধারিত হইবে। গণতন্ত্রের পক্ষে তাহা সুঅভ্যাস। কিন্তু, রাষ্ট্রপতির ভাষণ যে নূতন সম্ভাবনার দরজা খুলিয়া দিয়াছে, তাহাকে দেখিতে অস্বীকার করা রাজনৈতিক অপরিণতমনস্কতার পরিচায়ক।
নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতিগুলি কার্যকর হইবে, না কি কথার কথা হইয়াই থাকিয়া যাইবে, আসন্ন বাজেটে তাহার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাইবে। দীর্ঘমেয়াদে তিনি কী করিতে পারিবেন, অথবা কত দূর করিতে চাহেন, এই বাজেটেই তাহা স্পষ্ট হইয়া যাইবে। দেখিবার, তিনি ইউপিএ-র ভর্তুকি নীতি হইতে সরিয়া আসিতে পারেন কি না। মধ্যবিত্তের আঁতে ঘা লাগিবে, এমন সিদ্ধান্ত করিতে তিনি আদৌ প্রস্তুত কি? রাজকোষ ঘাটতির হারে লাগাম পরানোই তাঁহার প্রথম পরীক্ষা। এই ধাক্কাতেই সমস্ত কাজ সারিয়া ফেলিতে হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা তাঁহার নাই। কিন্তু, তাঁহার মন কোন দিকে, সেই ছাপ বাজেটে থাকিতে হইবে। নির্বাচনের ফলাফল তাঁহাকে বলিয়া দিয়াছে, মানুষ ভর্তুকির দয়া চাহে না, তাহার দাবি উন্নতির অনুকূল পরিবেশ। এই কথাটি জানিয়াও তিনি রাজনীতির বহুচর্চিত পথ ছাড়িতে পারিবেন কি না, আপাতত তাহাই বড় প্রশ্ন।