Advertisement
E-Paper

কত ভুলের সিঁড়ি বেয়ে সত্যে পৌঁছনো

এই সে দিন চতুর্দিকে ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছিল। নোবেল পুরস্কার নাকি বাঁধা। কয়েক মাস পরেই জানা গেল, ‘আবিষ্কার’-এ ভুল ছিল। বিজ্ঞানে এ-রকমই হয়। হয়েই থাকে।বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান চালচলনে ছিলেন একটু অন্য রকম। এ ব্যাপারে খ্যাতিও ছিল তাঁর মেধার দ্যুতির মতো বিস্তৃত। আচারব্যবহারে যিনি অতিমাত্রায় প্রাণোচ্ছল, জিনিয়াস হয়েও জিনিয়াস-সুলভ গাম্ভীর্য যাঁর কাছে ঘৃণ্য, বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে তাঁর ধারণাও যে হবে ভিন্ন, তাতে আর আশ্চর্য কী। ফাইনম্যান বিশ্বাস করতেন ঐতিহাসিক, সাংবাদিক— এমনকী বিজ্ঞানীরা নিজেরাও— গবেষণা জগতের বাস্তব ছবিটা সবার সামনে তুলে ধরেন না।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান চালচলনে ছিলেন একটু অন্য রকম। এ ব্যাপারে খ্যাতিও ছিল তাঁর মেধার দ্যুতির মতো বিস্তৃত। আচারব্যবহারে যিনি অতিমাত্রায় প্রাণোচ্ছল, জিনিয়াস হয়েও জিনিয়াস-সুলভ গাম্ভীর্য যাঁর কাছে ঘৃণ্য, বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে তাঁর ধারণাও যে হবে ভিন্ন, তাতে আর আশ্চর্য কী। ফাইনম্যান বিশ্বাস করতেন ঐতিহাসিক, সাংবাদিক— এমনকী বিজ্ঞানীরা নিজেরাও— গবেষণা জগতের বাস্তব ছবিটা সবার সামনে তুলে ধরেন না। বলেন না এই সত্য যে, বিজ্ঞান যতটা না সিদ্ধান্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি করে এক পদ্ধতি। গবেষণা হল মনে দ্বিধা, সন্দেহ, অভিলাষ এবং স্বপ্নের কুয়াশার মধ্যে পথ চলা। অথচ বিজ্ঞানের জার্নালে প্রকাশিত পেপারে কেবল ‘ফিনিশ্ড প্রডাক্ট’, ফ্যাক্টরির অন্দরে কালিঝুলির গন্ধ নেই সেখানে।

গবেষণা সম্পর্কে নিজের এ ধারণা ফাইনম্যান স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু জেমস ওয়াটসন’কে। সেই ওয়াটসন, ডিএনএ জিনিসটা কেমন দেখতে, তা বলতে পারার জন্য যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। এই বিশ্বে প্রাণের মূলে ওই অণুটির গঠন আবিষ্কার ছিল এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা। সে দৌড়ে যোগ দেন আটলান্টিকের দু’পারে বহু বিজ্ঞানী। তাঁদের প্রচেষ্টার, আসলে রেষারেষির, বর্ণময় কাহিনি লিখেছিলেন ওয়াটসন। ‘দ্য ডাবল হেলিক্স’ নামের সেই বইখানি ছাপার পরে হয়েছিল বেস্টসেলার। তো, ছাপার আগে তার পাণ্ডুলিপি ওয়াটসন পড়তে দিয়েছিলেন ফাইনম্যানকে। ককটেল পার্টিতে নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করে তিনি সারা রাত জেগে পড়েছিলেন সেই পাণ্ডুলিপি। তার পর বন্ধুকে লিখেছিলেন: ‘বইতে বর্ণিত মুখরোচক ঘটনাগুলি খাপে-খাপে মিলে দারুণ অর্থবহ হয়ে উঠেছে।... যারা বলে বিজ্ঞান এ ভাবে চর্চা করা হয় না, তারা ভুল করে। তুমি যখন বর্ণনা করেছ তোমার মাথার মধ্যে কী খেলছিল, যখন সত্য খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে এগোচ্ছিল তোমার দিকে, আর তার পর সব কিছু ধরা দিল স্পষ্ট ভাবে, তখন তুমি বলেছ বিজ্ঞান আসলে কী ভাবে চর্চা করা হয়। আমি তা জানি, আমারও আছে তেমন ভয়ঙ্কর ও সুন্দর অভিজ্ঞতা।’

ফাইনম্যানও পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। প্রথা অনুযায়ী সুইডেনের রাজার হাত থেকে প্রাইজ নেওয়ার পর ভাষণ দেওয়ার কথা। কী বলবেন ফাইনম্যান? অন্য বিজ্ঞানীরা ও-রকম বক্তৃতায় বর্ণনা করেন তাঁদের সাফল্য। ফাইনম্যান সে পথে হাঁটার পাত্র নন। বক্তৃতা দিতে উঠে তিনি নিন্দা করেছিলেন সেই অভ্যাসের, যার বশে বিজ্ঞানীরা গবেষণার ফলাফল পেশ করেন চূড়ান্ত ভাবে। সেই ফলাফলে পৌঁছনোর জন্য যে-সব পথে হেঁটেছেন, সেগুলির কথা বলেন না। বলেন না কানাগলিতে পথ হাতড়ানোর কথা। কিংবা প্রথমে মাথায়-আসা একেবারে ভুল আইডিয়ার কথা। আর তিনি? নিজেকে নিয়ে ঠাট্টার জন্য বিখ্যাত ওই বিজ্ঞানী বলেছিলেন, তিনি ছিলেন কতটা গবেট, আর তাঁর পিএইচ ডি গাইড কতটা বুদ্ধিমান। আর, যে সাফল্যের জন্য তিনি পাচ্ছেন নোবেল প্রাইজ, তাতে পৌঁছতে যত নতুন-নতুন আইডিয়া মাথায় খেলেছিল তাঁর, সে সবের মধ্যে কতগুলি ছিল ভুল।

ফাইনম্যান বলতে চেয়েছিলেন, বিজ্ঞান শুধু সাফল্যের নয়, ব্যর্থতারও ইতিহাস। বস্তুত, সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতাই বেশি। ব্যর্থতা যেহেতু গড়ে সাফল্যের ভিত, তাই সাফল্যকে চিনতে, তার মাহাত্ম্য বুঝতে, ব্যর্থতার খবরও জরুরি।

সাম্প্রতিক এক ব্যর্থতা ঘিরে বিজ্ঞানের জগতে খুব হইচই। হবেই। আজ যা ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত, তা গত মার্চ মাসে যে প্রচারিত হয়েছিল মস্ত সাফল্য রূপে। এত বড় সাফল্য যে, বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছিলেন, এ কাজ নোবেল পুরস্কার পাবেই। বিজ্ঞানে কৃতিত্বের সেরা স্বীকৃতি ওই পুরস্কারটির ব্যাপারে গণৎকারি যদিও চলে না, যোগ্য গবেষকের বঞ্চনার উদাহরণ যদিও অনেক, তবু কোনও কোনও কাজের বেলায় সেই অভিযোগ খাটে না। সে-সব ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নোবেল শিরোপার পূর্বাভাস। এবং মিলেও যায় সেই ভবিষ্যদ্বাণী।

এ-কালে এমন ঘটনার উদাহরণ দু’টি। ১৯৯৮ সালে দু-দল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন ব্রহ্মাণ্ডের এক বিচিত্র ধর্ম। মহাবিশ্ব নাকি আয়তনে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণে যে এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম, তা বহুকাল জানা। এও জানা যে, সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ শুরু। কিন্তু বিশ্বের দশ দিকে এত সব পদার্থ, গ্রহ-নক্ষত্র গ্যালাক্সি। সবাই একে অন্যকে কাছে টানছে মহাকর্ষের প্রভাবে। ফলে ব্রহ্মাণ্ডের বিগ ব্যাং-জনিত প্রসারণের হার কমে আসার কথা। কী হারে কমছে, সেটাই মাপার কাজে নেমেছিলেন দু’দল বিজ্ঞানী। নেমে তাঁরা অবাক। দেখলেন, ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণের হার কমার বদলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! জ্যোতির্বিজ্ঞানে শোরগোল। এবং বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হন একটা ব্যাপারে। এমন আবিষ্কার নোবেল প্রাইজ পাবেই। অনুমান ঠিক প্রমাণ করে ২০১১ সালে ওই সম্মানের জন্য নির্বাচিত হন দু’দলের থেকে তিন জন বিজ্ঞানী।

দ্বিতীয় উদাহরণ আরও কাছাকাছি সময়ের। ২০১২ সালে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে জেনেভার কাছে সার্ন গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন, খোঁজ মিলেছে ‘হিগস বোসন’ কণাটির। পদার্থের ভর জোগায় ওই কণা। পদার্থের ভর না থাকলে বিশ্ব বিরাজ করত না এই চেহারায়, হত তালগোল পাকানো এনার্জির একটা মণ্ড। সুতরাং, হিগস কণা-র গুরুত্ব ভীষণ। এতটাই যে, এক জন বিজ্ঞানী ঠাট্টা করে তাকে বলেছিলেন ‘ঈশ্বর কণা’। তত্ত্বে তার ইঙ্গিত মিলেছিল ১৯৬০-এর দশকে। অথচ বাস্তবে দেখা মেলেনি ৫০ বছরে। তল্লাশির ইতি ২০১২ সালে। আর, সাফল্য ঘোষণার সময় থেকেই পণ্ডিত মহলে গুঞ্জন। কবে নোবেল প্রাইজ? তা আসে পরের বছরই।

গত মার্চে যে আবিষ্কার ঘিরে নোবেল প্রাইজের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তা-ও বিরাট। সহজে বললে ব্যাপারটা এ রকম: ১-এর পর বসান ৩৮টা শূন্য। এ বার ১ সেকেন্ড সময়টাকে ওই পেল্লায় সংখ্যা দিয়ে ভাগ করুন। পাওয়া যাবে যে অকল্পনীয় ক্ষুদ্র সময়, ব্রহ্মাণ্ডের জন্মমুহূর্তের ঠিক ততখানি পরে কেমন ছিল তার অবস্থা, কী ঘটেছিল তখন, তা নাকি জানা গিয়েছিল।

কেমন পরিস্থিতি ছিল ব্রহ্মাণ্ডের জন্মকালে? নানা মুনির নানা মত। সবচেয়ে বিখ্যাত যে তত্ত্ব, তার প্রবক্তা দু’জন। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র অ্যালান গুথ ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির আন্দ্রেই লিন্দ। মহাবিশ্বের এক ধাঁধা সমাধানে ১৯৮০-র দশকে ওঁরা পেশ করেছিলেন বিশেষ তত্ত্ব। ধাঁধা? হ্যাঁ, ব্রহ্মাণ্ডের যে-কোনও জায়গা থেকে যে কোনও দিকে তাকালে দেখা যাবে গড়পড়তা পদার্থের পরিমাণ সমান। গ্যালাক্সি যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কিন্তু মোট হিসেব করলে পদার্থের পরিমাণ যেন দশ দিকে সমান। এ সাম্য কীসের জন্য?

গুথ ও লিন্দ বললেন, জন্মের পরেই ব্রহ্মাণ্ড যখন আকারে পরমাণুর কণা প্রোটনের মতন, তখন তা দ্বিগুণ, চার গুণ, আট গুণ হিসেবে প্রচণ্ড বেগে ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছিল। বেলুনের মতো। বেলুনে রবারের গায়ে দাগ থাকলে যেমন ফোলার পর সব হয়ে ওঠে মসৃণ, তেমনই সদ্যোজাত ব্রহ্মাণ্ডে পদার্থের ভিড় এদিক-ওদিকে বিক্ষিপ্ত হলেও অকস্মাৎ অতি দ্রুত প্রসারণে দশ দিকে পদার্থ ছড়ায় সমভাবে। আজকের সাম্যাবস্থা জন্মকালে ব্রহ্মাণ্ডের ওই প্রসারণের পরিণাম। গুথ ও লিন্দ তার নাম দিয়েছিলেন ‘ইনফ্লেশন’।

কিন্তু এ তত্ত্বের প্রমাণ? এ ব্যাপারে ত্রাণকর্তা আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব অনুযায়ী, পদার্থের উপস্থিতিতে তার চার পাশের শূন্যস্থান বা স্পেস দুমড়ে-মুচড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ভারী বস্তু, যার উপস্থিতিতে স্পেস আগেই দুমড়ে গেছে, তা যদি প্রচণ্ড বেগে ছোটে, তা হলে সেই শূন্যস্থানের মধ্যে একটা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। মহাকর্ষ তরঙ্গ। আইনস্টাইনের ওই দাবির সূত্রে গুথ এবং লিন্দ বলেছিলেন, ইনফ্লেশনে যেহেতু অকল্পনীয় বেগে প্রসারমাণ স্পেস-এর মধ্যে বস্তুর ছোটাছুটি, তাই ওই সময় নিশ্চই সদ্যোজাত বিশ্বে মহাকর্ষ তরঙ্গও সৃষ্টি হয়েছিল। খুঁজলে মিলবে তার চিহ্ন।

তা নাকি মিলেছিল। ১৫টি গবেষণাগারের ৪৭ বিজ্ঞানী আন্টার্কটিকায় বরফ সমুদ্রে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে দু’বছর ধরে খুঁজেছিলেন সে চিহ্ন, তাঁরা মার্চ মাসে দাবি করেছিলেন, শনাক্ত হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের পরমুহূর্তের মহাকর্ষ তরঙ্গের চিহ্ন। ইনফ্লেশন থিয়োরি ঠিক। ঘোষণামাত্র চার দিকে ধন্যি-ধন্যি। নোবেল প্রাইজের ভবিষ্যদ্বাণী।

শ্যামপেনের ফোয়ারা আজ স্তব্ধ। প্রতিদ্বন্দ্বী গবেষকদের সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই। যে ইঙ্গিত মিলেছে তা ব্রহ্মাণ্ডের জন্মকালে মহাকর্ষ তরঙ্গ, না কি অন্য কিছু? সন্দেহ সত্যি। মহাশূন্যে ঘুরছে যে প্ল্যাংক অবজারভেটরি, তা সম্প্রতি জানিয়েছে, ওই ইঙ্গিত মহাকর্ষ তরঙ্গের নয়। ‘মিল্কি ওয়ে’ গ্যালাক্সিতে ভাসমান ধূলিকণার প্রভাব।

একদা যে ৪৭ জন বিজ্ঞানী আনন্দসাগরে ভাসছিলেন, তাঁরা আজ ম্রিয়মাণ। এই বুঝি বিজ্ঞান। অলওয়েজ আ ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস।

pathik guha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy