ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক কোনও অর্থেই ওতপ্রোত নহে, বরং দ্বান্দ্বিক। ব্যক্তি যদি বিশেষ কোনও মত প্রকাশ করেন, তাঁহার সমাজের অন্তর্ভুক্ত সকল সদস্যের উহাই মত, এমন ভাবিয়া লওয়া তাই ঘোর নির্বুদ্ধিতা। এমনকী সামগ্রিক ভাবে সমাজও সেই মতের দায় লইতে হইবে, এমন ভাবাও অযৌক্তিক। কিন্তু যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ। তাই এই মুহূর্তে ভারতের বিভিন্ন অংশের মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিরা প্রাণপণে ইহা প্রতিপন্ন করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন যে, দিল্লির শাহি ইমামের বক্তব্য তাঁহাদের সকলের মনের কথা নহে। আগরার একটি মুসলিম গোষ্ঠী যে শুধু শাহি ইমামের বক্তব্যের সহিত নিজেদের দূরত্ব নিশ্চিত করিতেছেন তাহাই নয়, তাঁহাকে পাকিস্তানে চলিয়া যাইবার ক্রুদ্ধ অনুরোধ পর্যন্তই জানাইয়াছেন! সর্বভারতীয় মাদ্রাসা বোর্ডের পক্ষ হইতেও স্পষ্টাক্ষরে জানানো হইয়াছে, শাহি ইমাম সমগ্র ভারতীয় সমাজের মুখপাত্র নহেন, তাঁহার কথায় মুসলিমরা গুরুত্ব দিতে অনাগ্রহী।
কী বলিয়াছিলেন শাহি ইমাম? তাঁহার উত্তরাধিকারী শাহবান বুখারির অভিষেক অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ না জানাইয়া তিনি পাক প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। তদুপরি নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ-বার্তা না পাঠাইবার কারণ হিসাবে জানাইয়া দিয়াছিলেন যে, মোদী ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করেন, তাঁহাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নহেন, তাই তাঁহারও নৈকট্য কিংবা সহানুভূতির দায় নাই। যুক্তিটি শুনিতে যেমনই হউক, তাহার সহিত পাক প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে সহৃদয় আমন্ত্রণ জুড়িয়া গিয়া বিষয়টি দেখিতে ভাল হয় নাই। শাহি ইমাম অবশ্য এই ধরনের বিতর্কিত অবস্থান লইবার কারণে ইতিমধ্যেই বিখ্যাত। তাঁহার বিষয়ে দক্ষিণে বামে হিন্দু সমাজে মুসলিম সমাজে যে আলোড়ন তৈরি হইয়াছে, সে প্রসঙ্গে একটিই কথা বলিবার থাকে, তাঁহাকে উপেক্ষা করাই সবচেয়ে বুদ্ধির কাজ। তিনি অযথা বিতর্ক বাড়াইতে চাহেন। সত্যই বিতর্ক বাড়াইয়া তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার এক আনা প্রয়োজনও নাই।
মুশকিল এই যে, শাহি ইমাম এমন এক সমাজের পদস্থ ব্যক্তি যে সমাজ ভারতে সংখ্যালঘু। মুশকিল ইহাও যে, আপাতত যে রাজনীতির দেশময় জয়যাত্রা, যাহার মধ্যে সংখ্যাগুরু মানসিকতা আক্ষরিক ভাবে জ্বলজ্বল করিতেছে। এই প্রেক্ষিতেই অন্যান্য ভারতীয় মুসলিমদের শাহি ইমাম হইতে ত্বরিত দূরত্ব-বার্তা গভীর ভাবে ভাবাইয়া তোলে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাঁহারা কতখানি বিপন্ন বোধ করিতে পারেন, তাহার আন্দাজ পাওয়া যায় এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া হইতে। ব্যক্তি ও সমাজের যে সরাসরি সম্পর্কের সমীকরণ এ দেশে প্রচলিত, সেই সমীকরণ না পাল্টাইলে এই বিপন্নতার অবসান হইবে না। মহম্মদ আলি জিন্নার মতো বিরাট মাপের নেতাও যে ঔপনিবেশিক ভারতের মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন না, তাহা এখন ঐতিহাসিক সত্য, সে ভাবেই উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতেও কোনও একক মুসলিম নেতা গোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না। বস্তুত কোনও ব্যক্তিই সমগ্র সমাজের দর্পণ হইতে পারে না। এই সামান্য কথাটি অসামান্য রকম দুর্বোধ্য করিবার দরকার কী! শাহি ইমাম পাক প্রধানমন্ত্রীকে বন্ধুতার বার্তা পাঠাইতেই পারেন, ভারতীয় গণতন্ত্র তাঁহাকে সেই স্বাধীনতা দিয়াছে। তিনি যে সেই অধিকারের খামখা অপব্যবহার করিতেছেন, এইটুকু বুঝিয়া লইলেই হইল।