Advertisement
E-Paper

গ্রহ একটিই

ভয়াবহ। নৃশংস। পৈশাচিক। অকল্পনীয়। বিশেষণের তালিকা দীর্ঘায়িত হইতে পারে, তাহাতে প্যারিস হইতে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ব্যঙ্গচিত্র পত্রিকা ‘শার্লি এবদো’-র দফতরে সন্ত্রাসী আক্রমণের কারিগরদের কিছুমাত্র যায় আসে না। যাহারা ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিত দক্ষতায় এই ধরনের হত্যাকাণ্ড করিতে পারে, তাহাদের নিকট নিন্দাসূচক বিশেষণের কোনও অর্থ নাই।

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১

ভয়াবহ। নৃশংস। পৈশাচিক। অকল্পনীয়। বিশেষণের তালিকা দীর্ঘায়িত হইতে পারে, তাহাতে প্যারিস হইতে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ব্যঙ্গচিত্র পত্রিকা ‘শার্লি এবদো’-র দফতরে সন্ত্রাসী আক্রমণের কারিগরদের কিছুমাত্র যায় আসে না। যাহারা ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিত দক্ষতায় এই ধরনের হত্যাকাণ্ড করিতে পারে, তাহাদের নিকট নিন্দাসূচক বিশেষণের কোনও অর্থ নাই। সত্য ইহাই যে, এই বর্বরতাকে ধিক্কার জানাইবার ভাষা নাই। তথাপি সমগ্র বিশ্ব দ্বিধাহীন ভাবে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধিক্কার জানাইয়াছে। এবং সেই ধিক্কারকে অপ্রয়োজনীয় বলা চলে না, কারণ এই সমবেত ধিক্কারের মধ্য দিয়াই বিশ্বের এক বিরাট অংশ জানাইয়াছে: আমরা এই নৃশংস অসহিষ্ণুতার বিরোধী। এবং সমবেত হওয়া ও সমবেত থাকা এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাহার কারণ, এই জঙ্গি আক্রমণ কেবল একটি অপছন্দের পত্রিকার উপর হামলা নয়, ইহা স্বাধীনতার উপর, মতপ্রকাশের, ভিন্নমত পোষণ ও ব্যক্ত করার, গোষ্ঠীর যূথবদ্ধ ফরমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ করার নৈতিক অধিকারের উপরেই আক্রমণ। সেই সত্য উপলব্ধি করিতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশ্ববাসীর ভুল হয় নাই।

সাম্য, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাত্রের আদিভূমি বলিয়া গণ্য ফ্রান্সে ইউরোপের সর্বাধিক সংখ্যক মুসলিমের বাস। অন্য অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় সেখানে মুসলিমরা অপেক্ষাকৃত বেশি সুরক্ষিত। সে দেশের মুসলিম সংগঠনগুলি শার্লি এবদো-র উপর হামলাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করিয়াছে। বিভিন্ন ইসলামি রাষ্ট্র এবং সংগঠন হইতেও অনুরূপ প্রতিবাদ উচ্চারিত হইয়াছে। তবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা প্রণোদিত এমন আক্রমণ ইসলাম-আশ্রিত জঙ্গি শিবির হইতে এই প্রথম আসিতেছে না। ইতিপূর্বে বহু দেশেই কমবেশি ইহার প্রকোপ দেখা গিয়াছে। বাংলাদেশ ও ভারতে তসলিমা নাসরিন, ইংল্যান্ডে সলমন রুশদি তাঁহাদের লেখালেখির জন্য মৌলবাদী ফতোয়া ও জেহাদি হত্যাপ্রচেষ্টায় কঠোর নিরাপত্তাবলয়ে আত্মগোপন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। মধ্য যুগে ইনক্যুইজিশন-এর সময় ধর্মান্ধ খ্রিস্টান যাজকরা যে ভাবে ‘ধর্মদ্রোহাত্মক’ ব্যক্তি ও রচনা, সব কিছুই পোড়াইতেন, আধুনিক বিশ্বে তাঁহাদের স্থান লইয়াছে ইসলামের জেহাদিরা। তাহারা গায়ের জোরে, কালাশনিকভের শক্তিতে বিশ্বকে তাহাদের মনের মতো গোঁড়া ওয়াহাবি সুন্নি ইসলামে অন্তরিত করিতে চাহে।

পয়গম্বরের হাতে কালাশনিকভ ছিল না, শুদ্ধ ধর্মীয় চেতনা ও প্রাণবান আবেগ ছিল। তাঁহার নামে শপথ লওয়া জেহাদিদের তেমন কোনও আত্মিক শক্তি নাই। তাই সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধরত ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের স্বঘোষিত খলিফা আবু বরকত আল-বাগদাদির ব্যঙ্গচিত্র আঁকার ‘অপরাধে’ যাহারা এই হামলা চালাইয়াছে, তাহাদের ধর্মীয় সংবেদনায় আঘাত করা সঙ্গত কি না, কোন ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক কার্যকারণ এই মরিয়া উন্মাদনার পিছনে সক্রিয়, এখন তাহার চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় নয়। এখন সময় এই স্বাধীনতার শত্রুদের কঠোর শাস্তি বিধানের, তাহাদের ভীতিপ্রদর্শন, হুমকি, কণ্ঠরোধ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। শুধু ফ্রান্স বা ইউরোপ নয়, সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব বহু যুগের সংগ্রামের মধ্য দিয়া অসহিষ্ণু যূথবদ্ধতার বিরুদ্ধে ব্যক্তির মতামতের স্বাধীনতা অনুশীলন করার যে অধিকার অর্জন করিয়াছে, বাগদাদিদের জেহাদ যেন তাহা কোনও মতেই হরণ করিতে না পারে। ফ্রান্সের সাংবাদিককুল জেহাদিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করিয়া ব্যঙ্গচিত্রীদের প্রতি সংহতিতে একজোট। বিশ্বের সর্বত্রই মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করিয়া ভিন্নমত প্রকাশের, সমালোচনা করার, নৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিবেকবান মানুষদের অগ্রসর হওয়া উচিত। মানুষের হাতে গ্রহ একটিই।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy