Advertisement
E-Paper

গ্লোবাল বাঙাল

বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গবেষণা করতে গিয়ে তাঁর মূল ঐতিহাসিক প্রশ্নের দিশাটি কোনও দিন হারাননি সদ্য প্রয়াত ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী।সারস্বত সাধনায় তপন রায়চৌধুরীর সফর বেশ লম্বা ছিল, নানা দিকে ছড়ানো, মাঝে মাঝেই এ-দিক ও-দিক বাঁক নিয়েছে। নোয়াখালির মাস্টারমশাইয়ের হাতে ইতিহাস পাঠটা শুরু হয়েছিল বরিশাল শহরের স্কুলে, প্রায় আশি বছর ধরে সেই পড়া চলতেই থাকে, কখনও কলকাতায়, আচার্য যদুনাথ সরকারের কাছে শিক্ষানবিশিতে, কখনও হেগ শহরে, কিংবা দিল্লি, অক্সফোর্ড আর পেনসিলভানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে।

গৌতম ভদ্র

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
স্ত্রীর সঙ্গে প্রবাসে তপনবাবু। ছবি: চৈতালী দাশগুপ্ত।

স্ত্রীর সঙ্গে প্রবাসে তপনবাবু। ছবি: চৈতালী দাশগুপ্ত।

সারস্বত সাধনায় তপন রায়চৌধুরীর সফর বেশ লম্বা ছিল, নানা দিকে ছড়ানো, মাঝে মাঝেই এ-দিক ও-দিক বাঁক নিয়েছে। নোয়াখালির মাস্টারমশাইয়ের হাতে ইতিহাস পাঠটা শুরু হয়েছিল বরিশাল শহরের স্কুলে, প্রায় আশি বছর ধরে সেই পড়া চলতেই থাকে, কখনও কলকাতায়, আচার্য যদুনাথ সরকারের কাছে শিক্ষানবিশিতে, কখনও হেগ শহরে, কিংবা দিল্লি, অক্সফোর্ড আর পেনসিলভানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এত ব্যস্ততার মধ্যে প্রত্যন্ত কীর্তিপাশা থেকে আসা উদ্বাস্তু তপনবাবু যৌবনেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পড়া, পড়ানো আর সুবিধামত ইতিহাস নিয়ে লেখালিখিই তাঁর স্বধর্ম, অন্য কিছু পরধর্ম। ইতিহাস-চিন্তার ঝোঁকেই তিনি এক ধারে বাঙাল ও অন্য ধারে, আজকের ভাষায়, গ্লোবাল। তবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি তাঁর মূল ঐতিহাসিক প্রশ্নের দিশাটি কোনও দিন হারাননি। কী করে প্রত্যন্ত প্রদেশে বা সাধারণ দেশি মানুষের জীবনে দূর সভ্যতার বীজ এসে পড়ে, কোন কোন সূত্রে কী ভাবে ক্ষুদ্রের অবয়বে বৃহতের চিহ্ন থেকে যায়, সেই প্রশ্নের নানা উত্তর খোঁজাই ছিল তাঁর অন্বীক্ষা। ইতিহাস তো পথের পাঁচালি, ছোট ছোট গণ্ডি ছাড়িয়ে তা বিস্তৃত হয় বৃহত্‌ পরিসরে, অথচ ভিটের রেশটি থেকে যায়, রাণুর হাত ধরে বিশ্বভবঘুরে অপুর ছেলে কাজল সেই নিশ্চিন্দিপুরেই যেন বড় হতে থাকে, এই তাত্ত্বিক চেতনায় তপনবাবুর ইতিহাসদর্শন সমৃদ্ধ ছিল।

নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব লিখতে অনিচ্ছুক, জিজ্ঞাসু তপন রায়চৌধুরী লিখে ফেললেন প্রথম গবেষণাগ্রন্থ ‘বেঙ্গল আন্ডার আকবর অ্যন্ড জাহাঙ্গির’ (’৫৩/’৬৯)। বইটি ছাপা হয় মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের গৌরচন্দ্রিকা রূপেই। অনেক খামতি আছে, তপনবাবুও জানতেন, কিন্তু প্রশ্নটি তীক্ষ্ণ; মোগলবিজিত বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে উত্তর ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের নানা অভিঘাতের চরিত্র কী ছিল, সুলতানি বাংলায় সমাজের রূপান্তর বৃহত্‌ ভারতের টানে কী আকার পাচ্ছিল, জবাব খোঁজার চেষ্টা তিনি করেছিলেন। প্রাক্-ঔপনিবেশিক সমাজে ক্ষুদ্র ও বৃহতের সন্ধি ও সংঘাতের সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ডাচ ভাষা শিখে হেগ-এর বিশাল আর্কাইভস-এর নথি ঘেঁটে লিখলেন সপ্তদশ শতকের ভারতে সামুদ্রিক বাণিজ্যের এক পর্ব, ‘ইয়ান কোম্পানি ইন করমণ্ডল: ১৬০৫-১৬৯০’ (১৯৬২)। সমুদ্রবাণিজ্যের ওঠাপড়ার সঙ্গে দেশজ উপকূলের উত্‌পাদন ব্যবস্থা ও স্থানীয় রাজনীতির সালতামামি ধরে অনুপুঙ্খ আলোচনা এই রচনার বিষয়, সনাতন ওলন্দাজি ঘর ও বাহিরের টানাপড়েনকে পণ্য, বাণিজ্য ও বাজারের বর্গে বোঝার চেষ্টা।

এত দিনে গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। কলকাতা ছেড়ে তপনবাবু দিল্লিতে, তাঁর ভাষায় তখন জীবনটা ‘নরকে এক ঋতু’। কর্মজীবনে অসুখী ইতিহাসবিদ ব্যাপৃত হচ্ছেন সাংগঠনিক কাজে, ধর্মা কুমারের সম্পাদনায় বার হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি রিভিউ’, প্রবীণ নুরুল হাসান, ইরফান হাবিব থেকে নবীন মুজাফ্ফর আলম, সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম, সবাই তাঁদের গবেষণার প্রথম ফল ওই পত্রিকায় তুলে ধরেছেন। এর পরে তপনবাবু চললেন অক্সফোর্ডে, ওই একই পেশাদারি মান ও ঔজ্জ্বল্য নিয়ে যথাক্রমে ইরফান হাবিব ও ধর্মা কুমারের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় বার করলেন ‘কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’র দুই খণ্ড (১৯৮৬)। কীর্তিপাশা ও কলকাতার এককালীন তরুণ বাঙালি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক মহলে ও প্রতিষ্ঠানে সে দিন সামগ্রিক ভাবেই ভারতীয় ইতিহাস চর্চার জন্য স্থান কেড়ে নিয়েছেন।

মন চলো নিজ নিকেতনে। এত কেজোমির মধ্যেও তপনবাবু অতৃপ্ত। সমাজতত্ত্ব বা অর্থনীতির নিগড়ে বদ্ধ ইতিহাস তাঁকে খুব বেশি আকর্ষণ করে না, তাঁর মেজাজ আলাদা, তিনি ইতিহাসে শুনতে চান অতীত কালের ‘মানুষের অর্ধশ্রুত হৃত্‌স্পন্দন’। এই ফিরে কান পাতার তাগিদেই তিনি লিখলেন ‘ইয়োরোপ রিকনসিডার্ড’ (১৯৮০), কী ভাবে ভূদেব বা বিবেকানন্দের মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ইউরোপীয় সংস্কৃতির টানে সাড়া দিচ্ছেন, নতুনকে চয়নের নিজস্ব শর্তগুলো কী ভাবে বাঙালির বুদ্ধিচর্চায় ঘর ও বাইরের সন্ধি, সমবায় ও সংঘর্ষের আকার নিচ্ছে। এই উনিশ শতকীয় ভাবধারা কতটুকু ও কী ভাবে অন্তঃশীল হয়ে বইছিল বাঙালি গৃহস্থের মননে, পারিবারিক দিনচর্যা ও জীবনযাপনের কাহিনির মধ্যে তিনি সেই স্রোতটি খুঁজতে লাগলেন। গ্লোবাল ও বঙ্গালের যোগবিয়োগের প্রেক্ষিতে বেরোল বাঙালি মানসিকতা নিয়ে প্রবন্ধ সংকলন ‘পারসেপশনস, ইমোশনস অ্যান্ড সেনসিবিলিটিজ’ (১৯৯৯)। আরও গবেষণা চলছিল, শেষ আর হল না।

‘নিজ মৌজা কীর্তিপাশা’, তারই ‘রোমহর্ষক ইতিহাস’ বাংলা ভাষার পুস্তিকার নামটি ‘রোমন্থন ও ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিত চর্চা’ (১৯৯৩) আমার মতো অনপঢ় পাঠকের চোখে তাঁর শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকীর্তি। বরিশালের সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষদের মধ্যে সবাই আছেন, বংশের জমিদার প্রসন্ন সেন ও তস্য গৃহিণী জাঁদরেল ষষ্ঠীপ্রিয়া থেকে রোমাই কার্তিক, নমঃশূদ্র ও মুসলমান চাষা, বগা, চগা ও ধর্মারা। প্রথাগত আর্কাইভসের গণ্ডি ছাড়িয়ে বংশাবলি, কিংবদন্তি, অতিপ্রাকৃত কাহিনি, বরিশালি বাগধারা, আবার নিজের বানানো নতুন শব্দে ও কথাকণিকার বুনটে তৈরি তাঁর লেখা এই বই, টক-ঝাল-মিষ্টির স্বাদে ভরপুর। স্মৃতির একরূপ মাত্র ইতিহাস, স্মৃতির আরও অনেক রূপ আছে, অনেক সময়ই সেগুলি ভাঙা, ধারাবাহিক নয়, কালিক বিচারে অসম, তথ্য বিচারে নড়বড়ে। এই সব খণ্ডিত উপাদানকে নিয়ে তপনবাবু আখ্যানকৌশলে বরিশালের সংস্কৃতি ও সমাজের ত্রিশ ও চল্লিশের পর্বে ফিরে গেছেন। অতীতের কীর্তিপাশার লোকেরা দেশজ ভাষায় তাঁর সঙ্গে কথা বলছে, গালগল্পের মাঝে মাঝে ফুটে উঠেছে এক আসন্ন ক্রান্তিকালের অজানিত শঙ্কা ও অস্বস্তি। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা ও কথাকণিকাকে ঘিরে ইতিহাসের এই গোত্রের নির্মিতি বাংলা ভাষায় তো নয়ই, অন্য ভারতীয় ভাষাতেও আর কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই।

ঘর থেকে বাইরে যেতে হলে দরজা খুলতে হয়, চৌকাঠটি পেরোতে হয়। ‘সূচ তোর পেছনে কেন গর্ত?’ বলার সময় নিজের চালুনিটা দেখে নেওয়া ভাল। এক দিকে নানা আদর্শ মানুষের কথা তপনবাবু স্মৃতিকথায় বলেছেন, তাঁদের সান্নিধ্যের রসে ভরপুর হয়েছেন, কিছু কিছু ‘অমায়িক খচ্চর’কেও ছেড়ে কথা বলেননি। ইতিহাস তাঁর কাছে মানবিক বিদ্যা, তার চর্চা ক্ষুদ্রকে বৃহতে সম্প্রসারিত করে। তাই যে কোনও ধরনের সংকীর্ণতার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা ছিল, সাম্প্রতিক কালের গৈরিক উত্থানে সন্ত্রস্ত ছিলেন, পারলেই মুখে বা লিখে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতেন। বরিশাল থেকে একদা উদ্বাস্তু, আজীবন বাঙালি, অক্সফোর্ডবাসী এই ইতিহাসবিদ তাঁর সারস্বত সাধনায় মুক্তমনা হওয়ার জন্য বার বার যেন নিজের মধ্যেই ঘর ও বাহিরের সম্পর্ক খুঁজেছেন। নিজেকে খোঁজা ও চেনা তো কখনও ফুরোয় না, তারই সঙ্গে স্বকাল ও স্ব-সমাজকে জানা।

post editorial gautam bhadra tapan roy choudhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy