পাকিস্তানে আশ্রিত জেহাদি নেতা হাফিজ সইদ ও তাঁহার সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়া মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক ‘সন্ত্রাসবাদী’ ঘোষিত হইয়াছে। সইদ যে সন্ত্রাসবাদী, তাঁহার সংগঠন ভূতপূর্ব লস্কর-এ-তইবা বা তাহার নূতন অবতার জামাত-উদ-দাওয়া যে জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা, তাহা কাহারও অজানা ছিল না। ভারত তো মুম্বই কাণ্ডে ১৬৬ জনের মৃত্যুর বিনিময়ে তাহা জানিয়াছে। ভারতে অন্য অনেক সন্ত্রাসবাদী হামলায় সইদের অনুগামীরা জড়িত। তবে পাকিস্তান সরকার নাকি এ-সব কিছুই জানিত না, অন্তত জানিত বলিয়া স্বীকার করিত না। তাহার পশ্চিমী অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সইদকে লইয়া তত ভাবিত ছিল না। পাকিস্তানকে ঘাঁটি বানাইয়া যে-সব জেহাদি সংগঠন দেশের পূর্বভাগে অর্থাৎ কাশ্মীর ও ভারতে নাশকতায় লিপ্ত (যেমন হরকত-উল-মুজাহিদিন), তাহাদের লইয়া পাক সরকারের যেমন, তেমনই মার্কিন প্রশাসনেরও তত মাথাব্যথা ছিল না। তাঁহারা কেবল পশ্চিমী সেক্টর অর্থাৎ ওয়াজিরিস্তানে ঘাঁটি গাড়িয়া আফগানিস্তানে ও মূল পাক ভূখণ্ডে অন্তর্ঘাত চালানো জঙ্গিদের লইয়াই ব্যতিব্যস্ত থাকিয়াছেন। মার্কিন প্রশাসনের তরফে হাফিজ সইদকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা তাই নয়াদিল্লির পক্ষে সুসংবাদ।
তবে ইহাতে যে সইদের তৎপরতায় বিশেষ বিঘ্ন সৃষ্টি হইবে, এমন বোধ হয় না। ওয়াশিংটন সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার অতিরিক্ত কিছু করিবে, তাহার ভরসা কম। আর সইদের জেহাদি নাশকতা যত ক্ষণ ভারতের বিরুদ্ধে সঞ্চালিত, অনুমান করা যায়, তত ক্ষণ তাহা পাক সেনা-কর্তা তথা আইএসআইয়ের পক্ষে স্বাগত। এক মাসও হয় নাই এই জঙ্গি নেতা প্রকাশ্য সমাবেশে অনুগামীদের ভারতের বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্ত জেহাদ’-এ অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানাইয়াছেন। তাই সইদকে খামখা উত্ত্যক্ত করিয়া নওয়াজ শরিফের সরকার কেন লক্ষ্যচ্যুত হইবে? বরং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে বিমান-হানা চালানো অনেক বেশি জরুরি। ওয়াজিরিস্তানে ঘাঁটি গাড়া ‘তেহরিক-এ-তালিবান পাকিস্তান’-এর জেহাদিরা ইসলামাবাদের ঘুম কাড়িয়া লইয়াছে। যে দুঃসাহসিকতার সহিত তাহারা করাচি বিমানবন্দর, নৌ-ঘাঁটি, ইসলামাবাদের পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সহ বিভিন্ন সরকারি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করিয়া চলিয়াছে, তাহাতে পাক সরকার বিচলিত হইতে বাধ্য। দীর্ঘ কাল এই জঙ্গিদের পুষিবার পরিণাম এত দিনে পাক শাসক শ্রেণি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছে। আফগানিস্তানের উপর প্রভাব ও দখল কায়েম রাখিতে আইএসআই একদা এই জেহাদি জঙ্গিদের ব্যবহার করিলেও আজ তাহারা বন্দুকের নল পাকিস্তানের দিকেই ঘুরাইয়া ধরিয়াছে।
এই বিপর্যয় হইতে বাহির হইতেই পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ওয়াজিরিস্তানে বোমারু হামলার পাশাপাশি হাক্কানি গোষ্ঠীকেও চাঁদমারি করিতে নির্দেশ দিয়াছেন। ইহা নয়াদিল্লির পক্ষে আর একটি স্বাগত সমাচার। কেননা আফগানিস্তানে ভারতীয় দূতাবাস হইতে শুরু করিয়া ভারতীয় আর্থিক সহযোগিতায় নির্মীয়মাণ বিভিন্ন প্রকল্পে সন্ত্রাসী হামলায় হাক্কানি গোষ্ঠীর জঙ্গিরাই যুক্ত বলিয়া মনে করিবার কারণ আছে। আফগানিস্তান হইতে যাবতীয় ভারতীয় প্রভাব মুছিয়া ফেলিতে ইসলামাবাদ অতীতে ইহাদের কাজে লাগাইয়াছে। এখন হয়তো তেহরিক-ই-তালিবানের মতো এই গোষ্ঠীও ইসলামাবাদকেই নিশানা করিয়াছে। তাই নওয়াজ শরিফ জঙ্গি দমনে আর বাছাবাছি করিতেছেন না। হাফিজ সইদ অবশ্য তথাপি পাক কর্তৃপক্ষের কাছে ছাড় পাইতেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করিলে কী হয়, হাফিজের আয়ের মূল উৎস হাওয়ালা বাবদ সংগৃহীত অর্থ, যাহা পাকিস্তানের ভিতর হইতেই মেলে, মার্কিন-ইউরোপীয় ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের উপর তাঁহার জেহাদকে নির্ভর করিতে হয় না।