Advertisement
E-Paper

ঘর কাহাকে বলে

ঘর-এর মতো আপন, নির্ভয়, নির্ভার একটি শব্দের মধ্যে যে এত ভাঙন, এত সন্ত্রাস থাকিতে পারে, ইহা এক নূতন উপলব্ধি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘ঘরে ফেরার ডাক’ সেই উপলব্ধিতে একবিংশ শতকের ভারতকে পৌঁছাইয়া দিল। ভারত হিন্দুর ঘর, অ-হিন্দুরা তাই নিজ নিজ ঘরে ফিরুক, প্রস্তাব দিতেছেন ভিএইচপি নেতারা।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

ঘর-এর মতো আপন, নির্ভয়, নির্ভার একটি শব্দের মধ্যে যে এত ভাঙন, এত সন্ত্রাস থাকিতে পারে, ইহা এক নূতন উপলব্ধি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘ঘরে ফেরার ডাক’ সেই উপলব্ধিতে একবিংশ শতকের ভারতকে পৌঁছাইয়া দিল। ভারত হিন্দুর ঘর, অ-হিন্দুরা তাই নিজ নিজ ঘরে ফিরুক, প্রস্তাব দিতেছেন ভিএইচপি নেতারা। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের মুসলিমদের এই ডাক শুনিয়া কী রকম লাগিতে পারে, তাহা সম্ভবত ভারতে বসিয়া কোনও হিন্দুর পক্ষে কল্পনা করাও দুষ্কর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাকি এই নীতির প্রবক্তাদের বকিয়াছেন। তিরস্কার অনাবশ্যক নহে। মোদীর দল যে সকল সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের উপরই নির্ভর করুক না কেন, তিনি বিজেপি-র সভাপতি নহেন, তিনি ভারত নামক দেশটির প্রধানমন্ত্রী, যে দেশ ১৯৪৭ সালে একটি মৌলিক নীতির উপর দাঁড়াইবার জন্য অশেষ যন্ত্রণার মূল্য চুকাইয়াছিল, কিন্তু তবু সেই মূল বিশ্বাস হইতে এক বিন্দু নড়ে নাই। সেই বিশ্বাস, ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাস। ধর্মের পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এক ‘ঘর’ বানাইবার বিশ্বাস। কাশ্মীর হইতে কন্যাকুমারী, এই ভূখণ্ডের সব পরিচিতির সকল মানুষকে রাতারাতি ‘নাগরিক’ মর্যাদা দিবার যে উদার ঐতিহ্যে উন্নীত দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়াছেন মোদী, তাহাতে ‘ঘর’ লইয়া এই প্রবল বিপজ্জনক ছেলেখেলা সম্পর্কে তাঁহার হৃদয় যাহাই বলুক, মস্তিষ্কের সতর্ক এবং তত্‌পর হওয়া আবশ্যক।

কাহাকে বলে ঘর, মোদীর দল কি তাহা জানে? রহস্য নিষ্প্রয়োজন, যে মুসলিম ভারতীয়রা দেশময় ব্যাপ্ত হিন্দুত্ববাদীদের প্রাত্যহিক তজর্নগর্জন সহিয়া কেবল ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোটুকুকে বিশ্বাস করিয়াছেন, নিজ নিজ পিতৃমাতৃভূমির কল্যাণে মন দিয়াছেন, নিজেদের সন্ততিকে এই ভারতের স্বপ্নে রাখিতে চাহিয়াছেন, তাঁহাদের কাছে কোনটি ঘর, কোনটি বাহির? পরাধীন দেশের অতীতে যাইবার না-হয় দরকার নাই, স্বাধীন দেশের বর্তমানটিও কিন্তু তাঁহাদের অর্জন। যাহাদের চোখে সংকীর্ণতা ও সুবিধাবাদের চিরঠুলি আঁটা, তাহারা এই অর্জন না দেখিতেই পারে। কিন্তু যাঁহারা দেখিতে পান, তাঁহাদের কর্তব্য, এই সীমাহীন কুরুচির রাজনীতিকে সমূলে বিনাশ করা। মোদী যদি ভোট ও ক্ষমতার চক্রের বাহিরে তাকাইয়া কথাটি বুঝিতে পারেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের ‘যোগ্য’ হইবেন।

উত্তরপ্রদেশেরই বিপদ বেশি, তাই আলিগড়ের শিয়া ধর্মগুরু কালবে সাদিক কিছু বক্তব্য পেশ না করিয়া পারেন নাই। কতখানি ধৈর্য ও সহনশীলতা তাঁহার সেই মন্তব্যে নিহিত, তাহা জানিবার জন্য কথাগুলি পড়িতে বা শুনিতে হইবে। ধর্ম সমাজের একটি গভীরচারী সংস্কৃতি, তাহা থাকিবেই, এবং হয়তো জাতীয়তা বা রাষ্ট্রীয়তার পরিসরেও তাহা থাকিয়া যাইবে। কিন্তু ধর্মের নামে অসহন ও আক্রমণ ধর্মের অঙ্গ নহে, ধর্ম-সংস্কৃতির বাধ্যতা নহে। তাহা ধর্মের স্খলন। যে কোনও সমাজেই স্খলন স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্খলনকে সর্বজনীন করিয়া তুলিবার চেষ্টা, মান্যতা দিবার চেষ্টা অস্বাভাবিক। সাদিক এই সাধারণ কথাটিই মনে করাইয়া দিয়াছেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নয়, উত্তরপ্রদেশের মুসলিমদের। ভালই করিয়াছেন। তাঁহাদেরও ভাবিতে হইবে, ধর্মের নামে তৈরি যে পাকিস্তানে ধর্মের নামেই নারকীয়তার প্লাবন, তাহাই কি ঘর, না কি ধর্মনিরপেক্ষতার দেশ ভারতের যে ‘স্খলন’কে অগ্রাহ্য করিবার শক্তি আজও অমিত, ঘর আসলে সেখানেই?

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy