Advertisement
E-Paper

ঘরোয়া

গুছিয়ে সংসার করার মোহটা মেয়েদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। বাইরের দরজা যত বেশি খুলে যাচ্ছে, ভিতরের মুক্তিটা তত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।ভারতীয় মেয়েদের স্বভাব অনেকটা ভারতীয় রেলের মতো। দূরপাল্লার ট্রেন দাঁড় করিয়ে রেখে ক্রমাগত লোকাল ট্রেন পাস করাতে থাকে রেল। মেয়েরাও জীবনের বড় মাপের কাজগুলোকে অপেক্ষা করিয়ে ক্রমাগত ছোটখাটো কাজ সারতে থাকে। সাহিত্যচর্চা, শিল্পসাধনা, বিজ্ঞান গবেষণা, পেশাদারি প্রশিক্ষণ, এ-সব যদি হয় তবে হবে সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি কাজের শেষে। নইলে মাঝরাস্তায় ক্যানসেল।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩

ভারতীয় মেয়েদের স্বভাব অনেকটা ভারতীয় রেলের মতো। দূরপাল্লার ট্রেন দাঁড় করিয়ে রেখে ক্রমাগত লোকাল ট্রেন পাস করাতে থাকে রেল। মেয়েরাও জীবনের বড় মাপের কাজগুলোকে অপেক্ষা করিয়ে ক্রমাগত ছোটখাটো কাজ সারতে থাকে। সাহিত্যচর্চা, শিল্পসাধনা, বিজ্ঞান গবেষণা, পেশাদারি প্রশিক্ষণ, এ-সব যদি হয় তবে হবে সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি কাজের শেষে। নইলে মাঝরাস্তায় ক্যানসেল।

এ কেবল বাইরের চাপ নয়। মৈথিলি ভাষার সাহিত্যিক উষাকিরণ খান গল্প করছিলেন একটি মেয়ের কথা, যে অসামান্য গল্প লিখতে শুরু করেছিল। কিন্তু লেখাকে ছাড়িয়ে গেল তার ব্যস্ততা। “বারবার বললাম, আর কেউ তোমার কুকুরকে যত্ন করতে পারবে, বাগানে জল দিতে পারবে। কিন্তু গল্প বলার তরিখা তুমি পাকড়ে ফেলেছ, যা কম লোকই পারে।” শেষে কুকুরই জিতেছে, হেরেছে সাহিত্য। সদ্য পদ্মশ্রী-প্রাপ্ত, সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা উষাকিরণ এসেছিলেন গয়াতে, সাহিত্য-শিল্পে মেয়েদের পরিসর বিষয়ে আলোচনায়। ভারী শান্ত ভাবে বললেন, “এই রকম সভায় কেবল আমার নাম শুনবেন। আমায় দেখতে পাবেন। কারণ আর যে মেয়েরা লিখতে শুরু করেছিল, প্রায় কেউই ধরে রাখেনি।”

শুনে মনে পড়ল, যখন সবে কাগজে কাজ করতে ঢুকেছি, পাতা বানানোর ঘরের ইন-চার্জ সঞ্জয়দা ছবি বসাতে বসাতে বলেছিলেন, “মেয়েরা কাজ তো ভালই করে, কিন্তু লাস্টিং করে না।” পরের দশ-পনেরো বছরে দেখলাম, যারা ঝলসে উঠেছিল তারা কেমন করে মিলিয়ে গেল। মাস কমিউনিকেশন কিংবা জার্নালিজমের ক্লাসে ঠাসা মেয়ে। কিন্তু নবান্নে ঢোকার কার্ড যাদের আছে, তাদের খুব জোর ১০-১২ শতাংশ মেয়ে, প্রেস ক্লাবের সদস্যদের ১৫ শতাংশও নয়। মেয়েরা কেন এডিটর, চিফ রিপোর্টার হয় না তা নিয়ে তবু তর্ক হয়। কিন্তু জেলার মেয়েরা কলেজ-ইউনিভার্সিটি পাশ করেও সাংবাদিকতা করতে আসে না কেন, সে প্রশ্ন কেউ তোলে না। এই দৈনিকেই প্রায় আশি জন রিপোর্টার-ফোটোগ্রাফার কাজ করেন জেলায়। তার মধ্যে মেয়ে আড়াই জন (এক জন এখনও শিক্ষানবিশ)।

আমার দিদির অভিজ্ঞতা আরও করুণ। নৃত্যশিল্পী, নৃত্যের অধ্যাপক। বহু পরিশ্রমে বহু বছর ধরে যে বালিকাদের তালিম দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অতি প্রতিভাময়ীরাও শিল্পী হয়ে ওঠার মুখে মঞ্চ ছেড়ে দেয়। বিজ্ঞানের দশা তথৈবচ। যাঁরা পি এইচডি শেষ করেন, তাঁদের ৪০ শতাংশ মেয়ে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন মেরেকেটে ১৫ শতাংশ। মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চাকে ‘লিকিং পাইপ’ বলছে একটি রিপোর্ট।

কেন এমন হচ্ছে? কমল মিত্র কি অমরীশ পুরী টাইপের কেউ ক্রমাগত ধমক দিয়ে শিক্ষিত মেয়েদের ঘরে পুরে দিচ্ছে, এটা হজম করা কঠিন। এ তো একশো বার সত্যি যে আজও মেয়েদের সুযোগ অর্ধেক, কাজ ডবল, ঘরে-বাইরে সন্দেহ, লাগানি-ভাঙানি, চটুল মন্তব্য, কুটিল চাহনি। কিন্তু সে আর কবে না ছিল। ও সব জেনেবুঝেও প্রশ্নটা খচখচ করতে থাকে, যারা মাঝপথে ছেড়ে দিচ্ছে, তারা সকলে এতই নিরুপায় ছিল কি?

বাধা হয়তো অনেকটাই অন্তরের। রুটি বেলা, ঝুল ঝাড়া কিংবা কাপড় রোদে মেলার মতো কাজগুলো ব্যবহারিক অর্থ ছাড়িয়ে যায়। মেয়েদের জীবনে এগুলো যেন ‘ফেটিশ’, কাজের উদ্দেশ্য অর্থ হারিয়ে কাজগুলোই মেয়েদের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। ঘর গোছানো, রান্নাবাড়া, এ সব করতে পারাটাই যেন প্রাপ্তি। প্রতিদিনের জীবনে এই সব একঘেয়ে কাজ করতে মেয়েরা মোটেই ভালবাসে না, এক দিন কাজের মেয়ে না এলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অথচ যে জীবনের কেন্দ্রে এই কাজগুলো নেই, সে জীবন কল্পনা করতে বললেও মেয়েদের বুক ভেঙে যায়। কাপড়-গোছানো তাক, মশলার কৌটো সাজানো র্যাক, পর্দার সঙ্গে ম্যাচিং পাপোশ, এমন তুচ্ছ সব জিনিসও কী এক অলৌকিক জ্যোতির ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মেয়েদের চোখে। গুছিয়ে সংসার করার মোহ পুরুষদের আটকাতে পারে না, মেয়েদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। সে বাঁধন আলগা হতে পারে, ভেবেই শিল্পচর্চা, বিদ্যাচর্চা করা ঝুঁকি মনে হতে থাকে বহু মেয়ের। নইলে শুধু পক্ষপাত দিয়ে আজ মেয়েদের এমন হোলসেল হার-মানার ব্যাখ্যা চলে না।

অনেকে হয়তো এ কথায় রাগ করে বলবেন, সংসারে কি মেয়েদের সার্থকতা মেলে না? আমাদের মা-দিদিমারা কি তার চৌহদ্দিতেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাননি? এখানে একটু ভাবা দরকার। এটা ঠিকই যে তাঁরা মানুষের স্বাভাবিক সৃষ্টিপ্রতিভা দিয়ে সামান্য উপকরণে অসামান্য শিল্প তৈরি করেছেন। কিন্তু শিল্পচর্চা, জ্ঞানচর্চা, রাজনীতি বা সমাজসেবা, যে কোনওটাই সার্থক তখনই হয় যখন তা আমাদের এক থেকে অনেক, ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে নিয়ে যায়। বহু মানুষের বিস্ময়-বেদনা টের পাওয়া যায়। ‘মনের চলাচল যতখানি, মানুষ ততখানি বড়,’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মিহি-কাটা সুপুরি, কিংবা নিখুঁত গোল লুচির যতই সৌকর্য থাক, তা রচয়িতাকে মানুষ হিসেবে ‘বড়’ করে না। বড়ি-আচার-কাসুন্দি কি বিস্কুট-পুডিং যতই উপাদেয় হোক, তা কোনও উত্তরণ ঘটায় না। অন্তরে-বাহিরে যা প্রসার ঘটায় না, তার সাধনা কেন করবে মেয়েরা? পুরুষদেরও সাধ থাকে, কিন্তু তা অবসরের। উলবোনার মতো মেয়েলি সাধ মেয়েদের কর্তব্যের, এমনকী স্বধর্মের জায়গা নিয়ে বসে। তুচ্ছতার সাধনাই যেন মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক।

এই প্রবল মোহ আবরণ না থাকলে এত যুগ ধরে, এত অনায়াসে মেয়েদের শরীর আর শ্রমের উপরে দখলদারি করতে পারত না পুরুষ। মুক্তি যার স্বাভাবিক বলে মনে হয়, সে-ই তো মুক্ত। ‘অধিকার’ জিনিসটাই সেখানে বাহুল্য। নিশ্বাস নিতে আবার অধিকার লাগে নাকি? না যদি লাগে, তা হলে ‘মেয়েদের অধিকার’ মানেই বা কী? আজ ‘দেহের উপর অধিকার,’ কাল ‘সম্পত্তির অধিকার’, পরশু ‘রোজগারের অধিকার’, এমন নতুন নতুন অস্ত্র কেবল বাইরের শত্রু কোতল করতে নয়, মেয়েদের ভিতরের বন্দিত্বের শিকড় কাটতে। যা মানুষের সহজ মর্যাদাবোধও ভুলিয়ে দেয়। যে মেয়েকে স্বামী-শ্বশুর মারধর করে বার করে দিয়েছে, সে-ও কেঁদে বলে, “আমাকে ঘরের এক কোণে থাকতে দিক, আমি আর কিছু চাই না।” যার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়েছে শাশুড়ি-ননদ, আশি শতাংশ দগ্ধ সেই মেয়েও হাসপাতালে পুলিশকে বলে, স্টোভ ফেটেছিল। যদি বেঁচে ওঠে, ওই বাড়িতেই ফেরার আশা রয়েছে যে। নিঃস্ব, গৃহহীন পুরুষের চাইতেও বিত্তবান ঘরের শিক্ষিত মেয়ে-বউরা অসহায়, কারণ তারা বাস্তবিকই মনে করে যে গেরস্তালি হারালে বিশাল পৃথিবীতে তাদের সার্থক জীবনের রসদ নেই।

২০০৫ সালে জেহানাবাদে জেল ভেঙেছিল নকশালরা। এক সহকর্মী খবরের জন্য গিয়ে দেখেছিলেন, বিশাল কপাট খোলা, কেউ কোথাও নেই। ভিতরে ঢুকে কাজ সেরে যখন তিনি বেরিয়ে আসছেন, তখন বাইরে একটা জটলা থেকে গোটা কতক লোক, পরনে জেলবন্দির পোশাক, এসে তাঁকে বলেছিল, “দাদা, জেল কখন চালু হবে? আমরা ঢুকব।”

বাইরে যত বেশি দরজা খুলে যাচ্ছে, ভিতরের মুক্তিটা তত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

post editorial swati bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy