Advertisement
E-Paper

চল চল, অশান্তি করি

ছাত্ররা বেয়াদপি করবে আর সবাই সেটাকে বিপ্লব বলে তালি বাজাবে, এ-ই দস্তুর। কারণ ওদের থিম তো আমরা চঞ্চল আমরা উদ্ভট আআমরা নূতন যৌবনেরই থট। কিন্তু গানে ছন্দটন্দ মিলিয়ে ‘নিয়ম মানি না, তাই আমরা মহান’ প্রমাণ করে দেওয়া এক কথা, আর দিকে দিকে ‘ডিসিপ্লিনকে থুতু দিই, কারণ সেটাই রেভলিউশন’ মর্মে ডিগবাজি খেয়ে সেডিস্ট আনন্দ ভোগ আর এক।

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩

ছাত্ররা বেয়াদপি করবে আর সবাই সেটাকে বিপ্লব বলে তালি বাজাবে, এ-ই দস্তুর। কারণ ওদের থিম তো আমরা চঞ্চল আমরা উদ্ভট আআমরা নূতন যৌবনেরই থট। কিন্তু গানে ছন্দটন্দ মিলিয়ে ‘নিয়ম মানি না, তাই আমরা মহান’ প্রমাণ করে দেওয়া এক কথা, আর দিকে দিকে ‘ডিসিপ্লিনকে থুতু দিই, কারণ সেটাই রেভলিউশন’ মর্মে ডিগবাজি খেয়ে সেডিস্ট আনন্দ ভোগ আর এক। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডেকে ছাত্র পেটাইনি, মাইনেটা কিছুটা বাড়িয়েছিলাম, তা-ও সেটা বাড়ল বারো বছর পর। দু’সিমেস্টার ধরে সেই টাকার অংশ দিব্যি সব্বাই দিলও, তার পর হঠাৎ এখন হইহই। ঘেরাও। আমার রেজিগনেশন দাবি। যে লোকটা সব কিছু চালাচ্ছে, তাকে রিজাইন করাতে নিশ্চয়ই দারুণ লাগে। মনে হয়, বাস্তিল ধসিয়ে তার শবদেহের ওপর পা তুলে সেল্‌ফি ক্লিকছি। ক্ষমতা মাত্রেই তাকে খিস্তি করতে হবে, আর খুবসে তার নাক রগড়ে অপমান করতে পারলেই সাচ্চা বিপ্লবী হওয়া যাবে— বাঙালির এই থিয়োরিটা আমার চমৎকার লাগে। কত্ত সহজে ভাবনাচিন্তার জায়গাটা ডিলিট করা গেল। এক জন লোক রোজ রাত্রে মাতাল হয়ে ফেরার সময় হোমগার্ড দেখলেই গালাগাল দিত। জিজ্ঞেস করলে বলত, দেব না? শালা রাষ্ট্রের চামচা! উর্দি পরে আছে, তাই লোকটাকে গাল দিলে নেশন স্টেটকে বেশ এক হাত নেওয়া হয়। এই একই নোটেশনে: উপাচার্য? বের করে দে। হেডমাস্টার? ধরে থাবড়া। পুলিশ? ডিম ছোড়। বড়লোক? গাড়ির কাচ ভাঙ। মানে, বৃহত্তর দৃষ্টিতে ব্যাপারটা দেখছে আর কী। এই নির্দিষ্ট লোকটা কিচ্ছু খারাপ না করে থাকতে পারে, কিন্তু এ যার প্রতিভূ, সে তো বাই ডেফিনিশন খারাপ। তা হলে একে ঘেঁটি ধরে মারতে মারতে ধুতি খুলে দিলে ভুলটা কী হল? মারলাম তো আসলে সিস্টেমকে। আর সিস্টেম, কে না জানে, অলটাইম বিষখোক্কস। তাকে লাথাতে পারলেই, অটোমেটিক চে গেভারা। এদের দেখলে আমার মার্ক্সের একটা গানের কথা মনে পড়ে যায়। কার্ল না, গ্রাউচো মার্ক্স। ‘হোয়াটেভার ইট ইজ, আয়্যাম এগেনস্ট ইট!’

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতিগুলো পাকড়ে দেওয়ার জন্যে গুচ্ছের কমিটি করেছিলাম, ক্লাসরুমগুলোকে ঝকঝকে করেছিলাম, সোজা কথা, উন্নতির চেষ্টা করছিলাম। তাতে তো আদ্ধেক লোক খেপে বোম হবেই, কারণ বহু ঘুঘুর বাসায় মটমট শব্দ। ঝঞ্ঝাট পাকানো হচ্ছিল, তার পর তাতে ছাত্রছাত্রীদের শামিল করে নেওয়া হল। এটাই দুঃখ। গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই, ছাত্ররা যেন অশান্তি করার জন্য মুখিয়ে আছে। চল চল, অশান্তি করি, হেভি জমবে! আসলে অশান্তির বিশাল সুবিধে: ক্লাস করতে হয় না। যদি কলেজে এসে ক’বার চিৎকার করে, একটু ঘুরেঘারে চট বেরিয়ে যাওয়া যায়, তার পর সিনেমা দেখে, ঘুগনি খেয়ে বাড়ি ফেরা যায়, গ্র্যান্ড মস্তি! বিপ্লব করে মল-এ ঘুরে বেড়ানো, এ লাইফস্টাইলের তুলনা হয়? আর যারা কলেজের ভেতরে থাকে, নেতৃত্ব দেয়, তাদের মূল কিক: নিষ্ঠুরতার মজা। হায়ারার্কিটা উলটে, বাপ-মা’র বয়সি শিক্ষককে মুখের সামনে আঙুল ও বাপ-মা তোলা। এর আসলি চিলি সস: তুমুল অপমান করেও পার পেয়ে যাওয়ার আমোদ। অনেকের সঙ্গে মিশে গুন্ডামি করছি, তাই আলাদা করে শাস্তি দেবে না, আর এতগুলোকে তো সাসপেন্ড করার প্রশ্ন ওঠে না, তাইলে চল ঝুঁকিহীন তাণ্ডব চালাই, মিনারেল ওয়াটারের বোতল বাজাই মিউটিনির তালে তালে!

আমাদের এখনকার ছাত্র বিপ্লব তাই দুর্দান্ত এক পিকনিক। গান গাও, হল্লা মচাও, কোনও প্রত্যাঘাতের ভয় না রেখে আঘাত করে যাও। গণধোলাইয়ের মতো খানিকটা। আর, এক বার মার খেয়ে গেলে? দেখতে হবে না! আমার প্রতিবাদ তক্ষুনি, নিঃশর্তে, ঠিকতা-র লেবেল পেয়ে যাবে। তখন, দাবিগুলো ঠিক কি না, আন্দোলনপদ্ধতিতে নীতি বজায় থাকছে কি না— কিস্যু খেয়াল রাখতে হবে না, কারণ অপোজিশন প্রথম ফাউল করেছে। মুশকিল হল, নিজেকে যদি উত্তম বলো, তবে তো অধমের চেয়ে নীচে নেমে তাকে জব্দ করার পাঁকে আইটেম নাচলে হবে না! ক’দিন আগেই কাগজে কে যেন লিখেছিলেন, একটা আন্দোলনের ভাষা ও ভঙ্গি তার খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এগজ্যাক্টলি। সেটাই চিনিয়ে দেয় প্রতিবাদের স্পিরিটটাকে। সেখানে যদি বহুত অ্যাকাডেমিক লম্ফঝম্প করে মোদ্দা বলা হয়, তোর মাথায় উকুন হোক রে ড্যাকরা, তা হলে তা বস্তিঝুপড়ির কলপাড়ের কলহর চেয়ে বেশি কিছু আর হয়ে উঠতে পারে না, সে ওই আন্দোলনের পক্ষে তাবড় দিগ্‌গজ পণ্ডিত ‘এরা ভাষা ও সংস্কৃতির নয়া মাসতুতো ভাই নির্মাণ (না কি অবিনির্মাণ) করেছে’ লিখে নেত্য জুড়লেও না।

আসলে, সহজতার যুগ। সকাল সকাল উঠে ফেসবুকে চাড্ডি খিস্তি লেখো, চেনা বন্ধুরা সেই টার্গেটটাকে ঘিরে ধরে আরও নর্দমা ছুড়ুক, ব্যস, সব্বাই একদানে বিপ্লবী। যেতে-আসতে শুধু একটু মমতাকে গালাও, একটু আমেরিকাকে। কী রসালো শর্টকাট! খাটে বসে, ছাদে গড়িয়ে, প্রেমিকার সঙ্গে কৌচে এলিয়ে, শুধু মোবাইল টাচিয়েই গরগরে অ্যান্টি-এস্ট্যাবলিশমেন্ট। আগুনখেকো গেরিলা। গোরিলাও বলা যায়। ওরা কথায় কথায় বুক বাজায় না?

আমি রিজাইন করায় সবাই বেশ দুঃখিত। দাবি মিটে গেল, ক্লাস শুরু। ক্লাসে গিয়ে ভাবতে বলি, প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে, মুখ বুজে ক্ষমতাকে মেনে নেওয়ার শিক্ষা তো পেল্লায় অশিক্ষা, কিন্তু কী করছি কেন করছি— নিজেকে এ প্রশ্নে অনবরত যাচিয়ে নেওয়ার অভ্যাস যদি না থাকে, বিরোধীর চেয়েও কর্কশ যদি নিজেদের প্রতি না হতে পারো, অবিনয়ের পুলকে বারোয়ারি ভেসে পড়ার অশ্লীলতাকে চিনতে না পারো, তবে ‘শিক্ষিত’ বিশেষণটাকে আজ বাদে কাল ‌সত্যিই ওএলএক্সে বেচে দিতে হবে!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy