Advertisement
E-Paper

জুজু দেখাইবেন না

১৯১৬ সালে, মহাযুদ্ধের মধ্যপর্বে, জাপান সফরে গিয়া রবীন্দ্রনাথ অতিকায় যন্ত্রসর্বস্ব শিল্পনির্ভর পাশ্চাত্য সভ্যতার কঠোর নিন্দা করিয়াছিলেন। শিল্পবিপ্লবের পশ্চিমী মডেলটিই উন্নতির একমাত্র মডেল, এমন কথা রবীন্দ্রনাথ কখনও স্বীকার করেন নাই, জাপানেও বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি সেই ভিন্নমতই ঘোষণা করেন।

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০০:০২

১৯১৬ সালে, মহাযুদ্ধের মধ্যপর্বে, জাপান সফরে গিয়া রবীন্দ্রনাথ অতিকায় যন্ত্রসর্বস্ব শিল্পনির্ভর পাশ্চাত্য সভ্যতার কঠোর নিন্দা করিয়াছিলেন। শিল্পবিপ্লবের পশ্চিমী মডেলটিই উন্নতির একমাত্র মডেল, এমন কথা রবীন্দ্রনাথ কখনও স্বীকার করেন নাই, জাপানেও বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি সেই ভিন্নমতই ঘোষণা করেন। তাহা লক্ষ করিয়া ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের এক নজরদার তাঁহার কর্তাদের রিপোর্ট পাঠান। তাহাতে তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক জন অধিবাসীর নিকট এমন ভাষণ আশা করা যায় না, তবে হয়তো কবি বলিয়া এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া চলে।’ স্বাধীন ভারতের আই বি’র লোক হইলে তিনি সম্ভবত ছাড়টি দিতেন না, রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার পিছনে ‘বিদেশি হাত’ দেখিতে পাইতেন এবং তাঁহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা লইবার সুপারিশ করিতেন। নরেন্দ্র মোদী দিল্লির দরবারে অধিষ্ঠান করিবার কয়েক দিনের মধ্যেই কিছু অসরকারি সংস্থার নামে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো নালিশ করিয়াছে যে, তাহারা বিদেশি টাকা লইয়া দেশের উন্নয়নের ক্ষতি করিতেছে। স্পষ্টতই, আইবি’র প্রতিপাদ্য, ইহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা লওয়া উচিত।

বিভিন্ন এনজিও বিভিন্ন যুক্তিতে বিভিন্ন প্রকল্পের সমালোচনা করিয়া থাকে, কোথাও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে, কোথাও বহু মানুষের ছিন্নমূল হইবার আশঙ্কায়, কোথাও বা অন্য কোনও কারণে। তাহাদের সমালোচনা সর্ব ক্ষেত্রেই নির্ভুল, এমন নহে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই যে সমালোচনা সংগত ও গুরুত্বপূর্ণ, তাহাও স্পষ্ট। কিন্তু কোন অভিযোগ কতটা ঠিক, কতখানি ভুল, তাহা যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতেই বিচার্য, সমালোচনা সরকার তথা ক্ষমতাবানদের অপছন্দ হইলেও সেই সমালোচনার অধিকার অবশ্যমান্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘ঝোলাওয়ালা’ রাজনীতি ভারতের আর্থিক উন্নয়নের পথে সত্যই বাধা সৃষ্টি করিতেছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে তেমন উন্নয়ন-বিরোধী অবস্থান লইবার স্বাধীনতাও অনস্বীকার্য। নরেন্দ্র মোদীর ‘গুজরাত মডেল’ সম্পর্কে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ বহুশ্রুত। সেই অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় অন্যত্র। কিন্তু তাঁহাকে সতর্ক থাকিতে হইবে, তাঁহার ‘ভারত মডেল’ যেন গণতন্ত্রকে যথেষ্ট সম্মান করে। চিনের অর্থনৈতিক সাফল্য অবশ্যই অনুসরণীয়, কিন্তু ‘চিনের পথ আমাদের পথ’ নহে। আইবি রিপোর্ট সেই শঙ্কা জাগ্রত করিয়াছে। তাহা দূর করা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব।

দায়িত্ব ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজের মজ্জাগত ‘বিদেশি-বিরাগ’ দূর করাও। আজও এ দেশে ‘বিদেশি হাত’ বা ‘বিদেশি নজর’ বলিলেই স্বদেশি অন্তরাত্মা শিহরিত হইয়া উঠে, ‘দরজা বন্ধ করো’ বলিয়া শোরগোল শুরু হইয়া যায়। ইহা ষোলো আনা অযৌক্তিক ও অবান্তর। যে কোনও বিষয়ে সমালোচনার অধিকার দেশি বিদেশি প্রত্যেকের আছে। সমালোচক সংস্থা দেশি টাকায় চলিতেছে না বিদেশি টাকায়, তাহার বিচার তাই সম্পূর্ণ অবান্তর। বস্তুত, কোনও বিদেশি সংস্থা যদি সরাসরি এ দেশের কোনও উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে, তাহাকেও স্বাগত জানাইয়া সেই সমালোচনার যুক্তি বিচার করাই একটি গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে বিচক্ষণতার পরিচায়ক। অর্থনীতি ও দর্শনের শিক্ষক অ্যাডাম স্মিথ সুদূর অষ্টাদশ শতাব্দীতে বলিয়া গিয়াছেন, দূর হইতে, বাহির হইতে কোনও ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ যদি একটি সমাজের ন্যায় অন্যায় সম্পর্কে আপন মতামত জানান, তাহা সেই সমাজের পক্ষে মূল্যবান। সেই মতামত গ্রহণ করিতে হইবে, এমন নয়, কিন্তু তাহা গুরুত্ব দিয়া বিচার করিতে হইবে। তাহা গোয়েন্দার কাজ নহে। নরেন্দ্র মোদী বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। বিরূপ সমালোচনা বন্ধ করিতে বিদেশি জুজু দেখাইবার প্রবণতা কিন্তু দুর্বল এবং ভীরুকেই মানায়।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy