Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জাতপাতের প্রকোপ অবলুপ্ত নয়, লুক্কায়িত

অম্বেডকরের ‘অ্যানিহিলেশন অফ দ্য কাস্টস’ কি এ দেশে সম্ভব হয়েছে? এমনকী, পশ্চিমবঙ্গেও নয়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালবৈদিক সমাজে কি জাতিভেদ ছিল? এ বিষয়ে সম্প্রতি গবেষণা করেছেন ইতালির ঐতিহাসিক রবার্ট কলোসো। তাঁর সদ্য প্রকাশিত বইতে তিনি জানাচ্ছেন, বৈদিক সমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা একেবারেই ছিল না। বর্ণভেদ প্রথাও ছিল মূলত শ্রম-বিভাজন। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রাহ্মণত্ব পেত না উত্তরাধিকার সূত্রে। পরবর্তীকালে অসাম্য ও শ্রেণি বিভাজনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জাতপাতের ভেদাভেদও আসে। ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের বিকাশ হয়।

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৮
Share: Save:

বৈদিক সমাজে কি জাতিভেদ ছিল? এ বিষয়ে সম্প্রতি গবেষণা করেছেন ইতালির ঐতিহাসিক রবার্ট কলোসো। তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই (Ardor)-তে তিনি জানাচ্ছেন, বৈদিক সমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা একেবারেই ছিল না। বর্ণভেদ প্রথাও ছিল মূলত শ্রম-বিভাজন। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রাহ্মণত্ব পেত না উত্তরাধিকার সূত্রে। পরবর্তীকালে অসাম্য ও শ্রেণি বিভাজনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জাতপাতের ভেদাভেদও আসে। ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের বিকাশ হয়।

বৈদিক যুগ থেকে আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিম্নবর্গের মানুষ ধারাবাহিক ভাবে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন উচ্চবর্ণের মানুষ ও তাঁদেরই সহায়ক ধর্মশাস্ত্রকারদের হাতে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এই শূদ্র সমাজ হল ‘সভ্যতার পিলসুজ’।

পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচনা তুলনামূলক ভাবে কম। উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের জাতপাত নিয়ে আমরা যত আলোচনা করেছি তত আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত নিয়ে কখনও করি না। অনেকেরই ধারণা, পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নেই।

বাস্তব পরিস্থিতি আসলে কী?

ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র এ দেশে বহু এলাকায় দাস-সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। বৈশ্যরাও বহুস্থানে শূদ্রের স্তরে নেমে যান, গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে দাসবর্গের সংখ্যা বেড়ে যায় তা হলে বাংলায় জাতপাতের ক্ষেত্রে এই অনক্রম্যতা কি সম্ভব?

এখানে একটা কথা বলে রাখি। বাংলার ইতিহাসের প্রাচীনত্ব কিন্তু এখন প্রশ্নাতীত। আগে ভাবা হত, বঙ্গের ইতিহাস খুব বেশি হলে আলেকজান্ডারের আক্রমণ ও মৌর্য বংশ থেকে। অধ্যাপক পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত ১৯৬০ সালে gangaridae: A forgotten civilzation (journal of the Department of letters- Calcutta University) শীর্ষক এক গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ পেশ করে গোটা দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম অধিকর্তা। তিনিই প্রথম বাংলার মাটির নীচে ভুলে যাওয়া এক সভ্যতার কথা বলেন। সে এক প্রাগৈতিহাসিক বাংলা। একটা ছোট উদাহরণ ১৯৭৮ সালে পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার, মেদিনীপুর জেলার সিজুয়াঁ গ্রামের অদূরে আবিষ্কৃত এক তরুণ মানবের আংশিক রূপে শিলীভূত ভগ্ন চোয়াল। ভারতীয় ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রাচীন প্রাণীবিজ্ঞান শাখার বিশেষজ্ঞেরা এই ফসিলকে আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বের আদি-হোলাসিন পর্বের বলে মনে করছেন। এর মানে, বাঙালির ইতিহাসও কিন্তু কম সুপ্রাচীন নয়। তাই প্রাচীন ভারতে যে শূদ্রের ইতিহাস আছে, তা বাংলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

G.S.Ghurye মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ছিলেন। সমাজতাত্ত্বিক অধ্যাপক Ghurye ১৯৩২ সালে ‘কাস্ট অ্যান্ড রেস ইন ইন্ডিয়া’ নামে একটি বই লেখেন। লন্ডন থেকে এটি প্রকাশিত হয়। মজার ব্যাপার, ২০১১ সালেও বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। এতটাই প্রাসঙ্গিক এই বই। এই বইটিতেও বাঙালি শূদ্র সমাজের প্রাচীনত্ব কার্যত বৈদিক সময়ের সমসাময়িক মনে করা হয়েছে। বাংলার সমাজের জাতপাত নিয়ে G. S. Ghurye অনেক কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বাংলায় জাত ছিল মূলত দু’ভাগে বিভক্ত। ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র। শূদ্র সমাজ আবার চার ভাগে বিভক্ত ছিল— (উপ-জাতি)। (১) শত-শূদ্র (Sat-Sudra group)- কায়স্থ এবং Nabashakh নবশাক। (২) Jala Charniya Shudra: এই উপজাতির হাত থেকে ব্রাহ্মণেরা জল গ্রহণ করতে পারতেন। (৩) Jalabya baharya Shudra- এদের হাত থেকে ব্রাহ্মণেরা জল নিতে পারতেন না। (৪) অস্পৃশ্য- শূদ্র— তাঁরা গঙ্গার জলকেও স্পর্শ করতে পারতেন না। খাদ্যর ক্ষেত্রেও অনেক বিধিনিষেধ ছিল। এমন অনেক জাত ছিল যারা ব্রাহ্মণদের হাত থেকেও কাঁচা খাবার নিতে পারে না, আবার ‘পাক্কা’, মানে রান্না করা খাবার উচ্চজাত শুধু নয়, Myras and halwais-এর হাত থেকে উচ্চবর্ণের মানুষও সে খাদ্য নিতে পারত।

G S Ghurye লিখেছেন, a brah-min never thinks of accepting water, much less any cooked food from any caste but that of the brahmins and all the other castes or groups of castes more often follow the principle of accepting no cooked food from any caste that stands lower than itself in the social scale. কুয়োর জল ব্যবহার নিয়েও বাংলাদেশে এ সব জাতপাতভিত্তিক বাধানিষেধ ছিল। “Even wells are polluted if a low caste man drews water from them but a great deal depends on the character of the vessel used and of the well from which water is drawn. A masonry well is not so easily defiled as one constructed with clap pipes and if it exceeds three and a half cubits, in width so that a cow may turn round in it, it can be used even by the lowest castes without defilement. মন্দিরে শূদ্র জাতির প্রবেশও নিষিদ্ধ ছিল আমাদের বাংলাদেশে।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় অথবা সুমিত সরকারের মতো সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকরা মনে করেন, পশ্চিমবাংলায় এই জাতপাতের প্রকোপ পরবর্তীকালে কমে যাওয়ার পিছনে পশ্চিমবঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারও এই জাতিভেদকে লঘু করতে সাহায্য করেছে। এক তো ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ পাশ্চাত্য শিক্ষা, আশিস নন্দীর মতো সমাজ-মনোবিজ্ঞানী যে সেকুলারিজমকে ভারতীয় ধারণা নয়, মূলত ওয়েস্টার্ন কনসেপ্ট বলে অভিহিত করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন, সে সবের প্রভাবে বাংলায় জাতপাতের প্রকোপ কমে যায়। কিন্তু এখন মনে হয় কমলেও তা অবলুপ্ত নয়, লুক্কায়িত।

পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতা যেমন রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ধর্মাচারকে পৃথক করার চেষ্টায় সফল হলেও সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় হেজেমনি বা অনুশাসন থেকে ভারতীয় নাগরিককে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি, ঠিক সে ভাবে বৈষ্ণবধর্ম বা বুদ্ধর বাণী জাতপাতকে অবদমিত করলেও অম্বেডকরের ‘অ্যানিহিলেশন অফ দ্য কাস্টস’ কি এ দেশে সম্ভব হয়েছে? এমনকী, পশ্চিমবঙ্গেও নয়।

প্রথম প্রশ্ন হল, বৈষ্ণব ধর্ম পশ্চিমবঙ্গের জাতপাতের ফ্যাক্টরকে অবদমিত করল কী ভাবে?

পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘জন প্রতিনিধি’ নামক গ্রন্থে বলছেন, স্বাধীনতার আগের শেষ দশ বছরে সিডিউল্ড কাস্ট রাজনীতি হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আজ যাঁদের দলিত বলা হয়, সেই তথাকথিত অস্পৃশ্য জাতির নেতারা সে সময়ে এক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এই সময় হিন্দু উচ্চবর্ণের সামাজিক আধিপত্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের সময় বাংলায় শূদ্র সমাজ ভক্ত হন এবং সেই বৈষ্ণব ধর্মের নেতৃত্ব ছিলেন উচ্চজাতির ব্যক্তিরাই। ভক্তি মার্গ নিম্নবর্গকে উচ্চবর্ণের আনুগত্য মেনে নিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই উদ্বুদ্ধ করেছিল।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলাদেশের ইতিহাসে (তৃতীয় খণ্ড: আধুনিক যুগ) আছে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও শংকরাচার্যর দর্শন কী ভাবে জাতিভেদের অবসান ঘটাতে সাহায্য করে। রমেশচন্দ্র মজুমদার শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, (পৃষ্ঠা ২০৯) জাতিভেদ একটা উপায়ে উঠে যেতে পারে। সেই উপায়টা হচ্ছে ভক্তি। ভক্তের জাত নেই। চণ্ডালও যদি ভক্তিলাভ করে তবে সে আর চণ্ডাল থাকে না। আর একটি উপায় হচ্ছে, নিজেকে বোঝার জ্ঞানলাভ। কাশীতে শংকরাচার্য এক বার গঙ্গাস্নান করে উঠে আসছেন, এই সময় এক জন চণ্ডালের গায়ে গা লেগে গেল। তিনি বল্লেন, তুই আমায় ছুয়ে দিলি? চণ্ডাল বল্লে, ঠাকুর তুমি আমায় ছোঁওনি, আমিও তোমায় ছুইনি। তোমাতে আমাতে তফাত্‌ কী? তুমিও যা, আমিও তাই। তখন শংকরাচার্যের জ্ঞান হল।

‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ গ্রন্থে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক অসাধারণ প্রবন্ধ জাত-জাতি-জাতীয়তা। সেখানে পার্থবাবু বলছেন, কী মজার ব্যাপার। আধুনিক যুগে নিম্নজাতিরা বলছেন, জাত-পার্থক্য বজায় থাকুক। আর উচ্চজাতিরা বলছেন, সবাই সমান। তাঁরা সংরক্ষণ বিরোধী। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর বান্নিয়ার জাতির আন্দোলনের দাবি হল, তফসিলি জাতিদের মধ্যে বান্নিয়ারা সবচেয়ে নীচে অবস্থিত। তারাই না কি সবচেয়ে অত্যাচারিত।

তা হলে কি জাতিভেদ ব্যবস্থার মূল কাঠামোটাই উল্টে যাচ্ছে? আগামী সপ্তাহে এ নিয়ে আলোচনা করব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sahi jayanta ghoshal conversion row ritual bsp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE