পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নূতন নহে। বামফ্রন্ট আমলে সেই ব্যাধি মজ্জাগত হয়, দলের ক্ষমতা কায়েম রাখিতে দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করিবার যন্ত্রটি পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু সেই আমলে দুর্বৃত্তরা সচরাচর যন্ত্রই ছিল, যন্ত্রী হয় নাই। তাহাদের কেহ কেহ দরবারে স্থান করিয়া লইত বটে, কিন্তু মোটের উপর দলের ‘সম্পদ’রা যথাবলয়ে সীমিত থাকিত। উপরমহলে যাঁহারা বসিতেন, তাঁহাদের সাধারণত সেই আসনে বসিবার উপযোগী কিছু কৃতি থাকিত। তাঁহাদের মধ্যে অসমর্থ বা অপদার্থের অভাব ছিল না, কিন্তু বাহুবলী বা প্রতারকরা অবলীলাক্রমে রাজবৃত্তে ঢুকিয়া পড়িতেছেন, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভাণ্ডারে এমন রত্ন কমই ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবর্তন আনিয়াছেন, তাঁহার দরবারে হঠাৎ-নায়কের মেলা বসিয়া গিয়াছে। বস্তুত, অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বর্তমান জমানার উপরমহলে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন, যাঁহাদের সৃষ্টিশীল রাজনীতিতে বা প্রশাসনে বা সামাজিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের অভিজ্ঞতা বা স্বীকৃতি আছে। তাঁহাদের নিশ্চয়ই পাইকারি ভাবে দুর্বৃত্ত বলিয়া দাগাইয়া দেওয়া চলে না, কিন্তু ক্ষুদ্র রাজনীতি হইতে সরাসরি বড় মেজ সেজ চেয়ারে বসিয়া পড়িলে যোগ্যতার বিচার কঠিন হইয়া পড়ে। এবং এ ঘোর কলিতে রাস্তায় আশ্রিত রাজনীতি কোথায় শেষ হয় আর রাজনীতিতে আশ্রিত বোম্বেটেগিরি কোথায় শুরু হয়, তাহা নির্ধারণ করা আরও কঠিন। দুর্বৃত্তের রাজনীতিকায়ন ভারতের অন্য কোনও কোনও রাজ্যে পরিচিত ছিল, পশ্চিমবঙ্গ সেই তালিকায় নাম তুলিয়াছে। ইহা কেবল পরিবর্তন নহে, উন্নয়নও বটে।
প্রশাসন যখন দলতন্ত্রের বশ, তখন দল পুড়িলে প্রশাসন রক্ষা পায় না। যত দিন যাইতেছে, দলীয় অনাচার প্রশাসনকে বিপন্ন করিতেছে। সমস্ত বিপন্নতা সর্বদা প্রকাশ পায় না, যদিও তাহার নানা লক্ষণ নানা উপলক্ষে ধরা পড়ে, যেমন সরকারি আধিকারিকদের অনেকের কঠিন মুখমণ্ডলেই বিপন্নতা ও বিরক্তির অলিখিত কাহিনি পড়িয়া লইতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু রাজ্যের পুলিশ বাহিনীকে, বিশেষত বিবিধ উপদ্রুত ও সন্ত্রস্ত এলাকার স্থানীয় পুলিশকর্মী ও অফিসারদের বিপদের স্বরূপ উত্তরোত্তর প্রকট হইতেছে। দুর্বৃত্ত অধ্যুষিত শাসকদলের মঞ্চ হইতে পুলিশকে বোম মারিবার সুপরামর্শ বর্ষিত হইলে থানার দারোগা আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হইবেন, ইহাতে কোনও অসংগতি নাই। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের মেরুদণ্ড অনেক কাল যাবৎ নরম হইয়াছিল, এখন দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং দৌরাত্ম্যের ত্র্যহস্পর্শে তাহার সর্বাঙ্গে পক্ষাঘাতের লক্ষণ ক্রমে স্পষ্ট হইতেছে।
এই ব্যাধির একটি চিকিৎসা আছে। একটিই চিকিৎসা। দল এবং প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দুরাচারীদের কবল হইতে মুক্ত করা। তত্ত্বগত ভাবে দুইটি কাজ স্বতন্ত্র, দলের সংস্কার না করিয়াও প্রশাসনের সংস্কার সম্ভব। কিন্তু তাহার প্রথম শর্ত প্রশাসনকে দলীয় প্রভাব হইতে মুক্ত করা। শর্তটি উচ্চারণমাত্রেই স্পষ্ট হইয়া যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে তাহা পূরণের সম্ভাবনা শূন্য। প্রশাসন দলবশ, সুতরাং দলের সংস্কার জরুরি। কিন্তু সেই সংস্কার যাঁহার করণীয় এবং একমাত্র যাঁহার করণীয়, সেই সর্বময়ী নেত্রী অনুগতবৃন্দকে দরাজ হস্তে শংসাপত্র বিতরণে অক্লান্ত। তাঁহার রাজত্বে জনসভা করিয়া হিংস্র অশালীন প্ররোচনা দিয়া সস্নেহ প্রশ্রয় মেলে, দুর্নীতির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেশ হইবার আগেই তাঁহার নিকট ‘বিশ্বাস করি না উহারা চোর’ মর্মে অ্যান্টিসিপেটরি সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, আবার কোনও ‘কাছের মানুষ’ নিতান্ত ধরা পড়িয়া গেলে তৎক্ষণাৎ দূরে পরিত্যক্ত হয়। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, দল যেমন চলিতেছে, তেমন চলিবে। ত্র্যহস্পর্শই পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক দশা।