Advertisement
E-Paper

দ্বিধাবিভক্ত

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গভীর রাতের দূরভাষ-কথন এবং বামফ্রন্টের রাতারাতি দিল্লি কর্মসূচি পরিবর্তন: নাট্যমূল্যের বাইরেও এই ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রভূত। বামফ্রন্ট যে রাজ্য রাজনীতির প্রয়োজনে আবার নূতন করিয়া নিজেদের অ্যাজেন্ডা ভাবিতেছে, বিজেপি-বিরোধিতায় তৃণমূল কংগ্রেস-এর ‘বি টিম’ না হইয়া প্রত্যয়ের সঙ্গে স্বাধীন পথে অগ্রসর হইতে চাহিতেছে, ইহা অতি সুলক্ষণ।

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গভীর রাতের দূরভাষ-কথন এবং বামফ্রন্টের রাতারাতি দিল্লি কর্মসূচি পরিবর্তন: নাট্যমূল্যের বাইরেও এই ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রভূত। বামফ্রন্ট যে রাজ্য রাজনীতির প্রয়োজনে আবার নূতন করিয়া নিজেদের অ্যাজেন্ডা ভাবিতেছে, বিজেপি-বিরোধিতায় তৃণমূল কংগ্রেস-এর ‘বি টিম’ না হইয়া প্রত্যয়ের সঙ্গে স্বাধীন পথে অগ্রসর হইতে চাহিতেছে, ইহা অতি সুলক্ষণ। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধিতারও বিবিধ ও বিভিন্ন প্রকরণ থাকিতে পারে, খামখা অন্য দলের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজের রাজনৈতিক চিন্তার দৈন্য প্রকট করিবার প্রয়োজন কী? বিশেষত যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতাপে তাহারা পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ গ্রস্ত, তাহার পদাঙ্ক অনুসরণে সম্পূর্ণ কৃতিত্বই যে বিপক্ষেরই জুটিবে, ঠিক সময়ে এইটুকু বুঝিবার রাজনীতিবোধ কিছু বাম নেতার এখনও আছে, তাহা স্বস্তিদায়ক। কিন্তু কেবল একাধারে বিজেপি ও তৃণমূলের বিরোধিতার দুঃসাহসই নয়। রাজ্যের কোনও বাম নেতা যে রাজ্য রাজনীতির স্বার্থে জাতীয় রাজনীতির কর্মসূচি পরিবর্তনের ডাক দিতে পারিলেন, ইহার গুরুত্ব গভীরতর। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার সময়োচিত সতর্কবাণীর মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতির একটি অত্যন্ত মৌলিক সমস্যার দিকে নির্দেশ করিয়া দিলেন।

সমস্যাটি কী? এই মুহূর্তে সি পি এম-এর জাতীয় স্তরে মুখ্য শত্রু বিজেপি, আর রাজ্য স্তরে, তৃণমূল। এমতাবস্থায় তৃণমূল-ও যদি বিজেপি-র শত্রুতায় সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ করে, এবং কেন্দ্রে বিজেপি-বিরোধিতার নেতৃত্ব দিতে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে সি পি এম-এর করণীয় কী? অর্থাৎ রাজ্যের স্বার্থ আগে? না, জাতীয় রাজনীতির স্বার্থ আগে? পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি উত্থানের আগে এই সংকট স্বভাবতই এত তীব্র ছিল না। কিন্তু রাজ্যে বিজেপি-র দ্রুত শক্তিবৃদ্ধির ফলে সি পি এম ও তৃণমূল এখন সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতার অঙ্গনটি একত্র বিহার করিতে ব্যগ্র, যাহা হইতে ‘ফিশফ্রাই’ রাজনীতির সূচনা। তবে কেন্দ্রীয়-প্রাদেশিক রাজনীতির এই দ্বন্দ্বটি নূতন নহে। সি পি এম আগেও একাধিক বার একই সংকটে হাবুডুবু খাইয়াছে। ২০০৮ সালে মার্কিন-ভারত পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করিয়া যখন প্রকাশ কারাটরা ইউ পি এ জোট ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসেন, রাজ্য সি পি এম সেই অবস্থান সমর্থন করে নাই। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব রাজনৈতিক সমীকরণ ও দিল্লির সমীকরণ যে কত ভিন্ন অভিমুখী হইতে পারে, গত সাড়ে তিন দশকে তাহার বহু বার মিলিয়াছে।

স্বভাবতই এই সমস্যা কেবল সি পি এম-এর নয়, কেবল পশ্চিমবঙ্গেরও নয়। সম্প্রতি কর্র্নাটক বা মহারাষ্ট্রের বিজেপি রাজনীতিতেও এই সংকট একই ভাবে প্রতিফলিত। ভারতের মতো দেশে কোনও রাজনৈতিক দল যদি একই সঙ্গে প্রাদেশিক ও জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে যুক্ত থাকে, নির্বাচনে লড়াই করে, তবে সেই দলের নীতির মধ্যে সংকট, এমনকী পরস্পরবিরোধিতা অত্যন্ত স্বাভাবিক। জাতীয় রাজনীতির বাস্তব ও প্রাদেশিক ক্ষমতার বাস্তব এক খাতে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা ব্যতিক্রম বলিলেই চলে। সুতরাং রাজ্য স্তরে এক নীতি, জাতীয় স্তরে অন্য নীতি, এই একটি পথ হওয়া সম্ভব। কিংবা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার যুক্তিতে জাতীয় ও রাজ্য স্তরের দলগুলি সম্পূর্ণ আলাদা হইবে: ইহাও হয়তো সম্ভব। নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্য ও পঞ্চায়েত স্তরের দলগুলিকে আলাদা করিয়া দিবার প্রস্তাব পূর্বে আসিয়াছে, কিন্তু কখনওই তাহা বাস্তবায়িত করা যায় নাই। আশ্চর্য যে, কেবল স্বাধীন ভারতে নয়, ব্রিটিশ ভারতেও কিন্তু বড় দলগুলির জাতীয় ও প্রাদেশিক স্তরের মধ্যে বিরোধিতা ছিল। মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় সংগঠন ও বঙ্গীয় সংগঠনের মধ্যে বিরোধিতার ইতিহাস অজানা নয়। দেশের স্বাধীনতাও যে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার রাজনীতিটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ভাবে প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই, এই ধারাবাহিকতা তাহারই প্রমাণ।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy