ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ ছিল, এই সরকার নীতিপঙ্গুত্বে ভুগিতেছে, ইহার সিদ্ধান্তগ্রহণের এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার তৎপরতা নাই। ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী প্রচারে এই অভিযোগ স্বভাবতই বহুশ্রুত ছিল। ক্ষমতাসীন হইবার পরে প্রথম এক সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদী স্থবিরতা হইতে তৎপরতায় উত্তরণের কিছু প্রাথমিক সংকেত দিয়াছেন। ‘মন্ত্রিগোষ্ঠী’ রদ করিবার সিদ্ধান্তটি সেই তালিকায় অগ্রগণ্য। মনমোহন সিংহের সরকার মোট ২১টি ‘মন্ত্রিগোষ্ঠী’ এবং ৯টি ‘বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠী’ তৈয়ার করিয়াছিল। ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, যে সকল প্রশাসনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইতে একাধিক মন্ত্রকের অনুমোদন দরকার, সেই সব বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে সুসমন্বিত এবং ত্বরান্বিত করা। বাস্তবে বিপরীত ফলই ফলিত। প্রায় কোনও বিষয়েই সরকার কোনও সিদ্ধান্ত লইয়া উঠিতে পারিত না। নরেন্দ্র মোদীর সরকার এক ধাক্কায় ওই সব মন্ত্রিগোষ্ঠী বাতিল করিয়া এক ঢিলে দুইটি পাখি মারিতে চাহিয়াছে। এক, প্রত্যেক মন্ত্রীর দায়বদ্ধতা বাড়ানো এবং দুই, দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ সুনিশ্চিত করা।
ইউপিএ আমলের মন্ত্রিগোষ্ঠীর বাস্তব অপকারিতা বুঝিবার জন্য কয়েকটি পরিসংখ্যান যথেষ্ট। এক মন্ত্রীর আপত্তিতে ক্রমাগত অন্য মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত বানচাল হইতে থাকে। শিল্প বা খনি মন্ত্রকের সহিত পরিবেশ মন্ত্রকের বোঝাপড়ার সমস্যারও মীমাংসা হয় না। বরিষ্ঠ মন্ত্রীরা সময় দিতে না পারায় কোনও কোনও মন্ত্রিগোষ্ঠী দুই বছরে এক বারও বৈঠকে বসিতে পারে নাই। প্রসার ভারতী বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠী ২০১১ জুনের পর আর বৈঠক করে নাই। নদী সংযুক্তি কিংবা অমৃতসর কলিকাতা ‘ফ্রেট-করিডর’-এর মতো বিষয়গুলি বিবেচনার জন্য গঠিত মন্ত্রিগোষ্ঠী এক বারও বৈঠক করে নাই। যে-সিদ্ধান্ত একক ভাবে এক জন মন্ত্রীর লওয়া উচিত, অন্য মন্ত্রকের সহিত বিরোধ বা দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইলে যাহাতে প্রধানমন্ত্রীর নিজের হস্তক্ষেপ করা উচিত, তাহা মন্ত্রিগোষ্ঠীর বিবেচনার উপর ছাড়িয়া দেওয়ার ফলে এক দিকে ব্যক্তি-মন্ত্রীদের দায় এড়াইবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, অন্য দিকে প্রশাসন দীর্ঘসূত্রী হয়। প্রশ্ন ওঠে, তবে ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভার প্রয়োজন বা গুরুত্ব কী রহিল? প্রধানমন্ত্রীর এক্তিয়ারেরই বা কী হইল? নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রশাসনে এই অসামঞ্জস্য ঘুচাইতে তৎপর হইয়াছে।
মন্ত্রকের প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্মকে ‘মন্ত্রিগোষ্ঠী’র হাতে ন্যস্ত করা বা তাহার উপরে ‘বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠী’ চাপাইয়া দিবার মধ্যে এক ধরনের মানসিক ব্রাহ্মণ্যবাদের ঔপচারিকতা ও আচারসর্বস্বতার প্রভাব আছে। কোনও কাজ সুষ্ঠু ভাবে করিতে হইলে কর্তাকে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হইবে। কাজটি দক্ষিণ হস্তে করা হইতেছে, না বাম হস্তে, ডান পার্শ্বে কাত হইয়া নাকি বাম পার্শ্বে, কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়া নাকি গোবরের তিলক আঁকিয়া, ইত্যাকার খুঁটিনাটি লইয়া ব্যতিব্যস্ত হওয়া অর্থহীন, হাস্যকর। মানসিকতার এই সমস্যাই মন্ত্রিগোষ্ঠী গঠনের মূলে। কাজ করার জন্য কাজ করার সদিচ্ছাই যথেষ্ট। কাজের বাধা দূর করিতে নিশ্চয় ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বা হস্তক্ষেপও কখনও কখনও জরুরি হইতে পারে। কিন্তু পদে পদে কাজের সীমানা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া, সমন্বয় বা যৌথ দায়িত্বের নামে নির্দিষ্ট কোনও এক জন কর্তাকে তাঁহার কর্মের জন্য দায়বদ্ধ না-করার রীতি বিভ্রান্তিকর। অধিকাংশ মন্ত্রকের কাজকর্ম এখন খুব জটিল এবং একক কোনও মন্ত্রীর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল নয়-- ইউপিএ-র এমন যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এই যুক্তিতে ক্যাবিনেটের কর্তৃত্ব এবং সরকারি প্রশাসনের সচলতা, উভয়ই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ইতিহাস তাহার সাক্ষী। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নরেন্দ্র মোদীর সিদ্ধান্ত স্বাগত।