খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে তাঁহাদের নানা বিশেষণ। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল, গৃহকর্মনিপুণা ইত্যাদি ইত্যাদি। রূপময়ী ও গৃহকর্মনিপুণা হইলে ভারতীয় বিবাহবাজারে তাঁহাদের বড়ই কদর। শুধু কি দেশে? বিদেশেও। আহা রে! ছেলে আমার প্রবাসে দৈবের বশে হস্ত পুড়াইয়া খাদ্য গ্রহণ করিতেছে। সুতরাং গৃহকর্মনিপুণা, রন্ধনপটু পুত্রবধূ প্রয়োজন। অনুসন্ধান ও প্রেরণ। ইহা ভারতীয় বিবাহতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র-বাহিত মানসিকতা। ব্যতিক্রম থাকিতে পারে। তবে মোটের উপর ইহাই নিয়ম। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষাতেও বিষয়টি প্রতিফলিত। ভারতীয় পুরুষরা নাকি অপরাপর দেশের পুরুষদের তুলনায় বাড়ির কাজে নিতান্ত সামান্য সময় ব্যয় করিয়া থাকেন। এই জাতীয় পরিসংখ্যানে নানা প্রকার সরলীকরণ থাকিতে পারে, তথাপি ভারতীয় পুরুষরা যে বাড়ির কাজে খুব একটা মনোযোগী নহেন, ইহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। ইহা চলিয়া আসিতেছে। ট্র্যাডিশন। পৌরাণিক কাল হইতেই। শিব-দুর্গার কাহিনি মঙ্গলকাব্যে ব্যবহৃত। মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গলে অপদার্থ শিবের কথা পাওয়া যাইবে। নেশাখোর পুরুষটি অকর্মণ্য। তবে ভোগের শখ ষোলো আনা। একা হাতে দুর্গা সংসার চালাইয়া থাকেন। রন্ধন, সন্তানপালন সব কিছু দুর্গাকেই সামলাইতে হয়। শিব খোঁজখবর কিছুই গ্রহণ করেন না। দেবদেবীর উদাহরণ টানিয়া যদি ভারতীয় পুরুষ কিছু সুবিধা পাইতে পারে, তাহা হইলে ছাড়িবে কেন? ভারতীয় সংসারে প্রায়ই বধূটিকে দুর্গার সহিত তুলনা করা হইয়া থাকে। দশভুজা বলিয়া ডাকা পুরুষতন্ত্রের একটি কৌশল: তুমি দশভুজা, ঘরের কাজ করিবে, দরকারে বাহিরেরও, আমি তোমাকে দশভুজা বলিয়া ডাকিয়া অলীক খুশির স্বর্গে তুলিয়া দিয়া পায়ের উপরে পা তুলিয়া আরাম করিব।
এই তন্ত্রের সাধনায় ক্ষতি কেবল মেয়েদের নহে, সমগ্র সমাজের। বড় বড় কথা কপচাইয়া লাভ নাই। যদি সত্যই লিঙ্গ বৈষম্য দূর করিতে হয় তাহা হইলে পুরুষদের গৃহকর্মে হস্ত লাগাইতে হইবে। রন্ধন, সাফসুতরো, সন্তানদের টিফিন গোছানো। আসলে এই সহযোগ শুধু সংসারের পরিবেশকেই সুমধুর করে না, পারস্পরিক বোঝাপড়াকে সুদৃঢ় করিয়া থাকে। নারীর জগৎ সম্বন্ধে পুরুষদের ধারণা গড়িয়া ওঠে। তাহাদের আর আলাদা গ্রহের বাসিন্দা বলিয়া তখন মনে হয় না। গৃহশ্রমও যে গুরুত্বপূর্ণ, হাতে-কলমে করিলে পুরুষরা তাহা টের পাইবেন। অনেক পুরুষ মনে করেন বাইরের কাজটাই কাজ, ঘরের কাজ কিছু না। ফলে ‘হোমমেকার’ যাঁহারা, সেই নারীদের তাঁহারা নিতান্ত গৃহবধূ ভাবিয়া তুচ্ছ করিয়া থাকেন, মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া থাকেন। এই অবস্থা বদলাইবে, শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হইবে।
ভাগাভাগি হইতে বৈরী মনোভাবের জন্ম। তোমার ঘর আমার বাহির— এই বিভাজন যত মুছিয়া যায়, তত ভাল। সহযোগই জীবনে গতি দেয়। আগামী ভারতের জনসংখ্যায় ত্রিশ বছরের কমবয়সি প্রজন্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ হইবে। এই নব্যভারতে নারী-পুরুষ উভয়েই প্রয়োজনে বাহিরের কাজে অংশগ্রহণ করিবেন। ঘরের কাজ ভাগ করিয়া লইতে হইবে। লওয়াই উচিত। সুতরাং ভারতীয় পুরুষ গৃহকর্মনিপুণ হইবার প্রয়াস গ্রহণ করুন। কোনও বিষয়েই অপরের শ্রমের উপর নির্ভর করা উচিত নহে। ভদ্রলোক-মধ্যবিত্ত পুরুষেরা কাজে নামুন। নিম্নবিত্ত সমাজেও পুরুষেরা গৃহশ্রমবিমুখ— সেখানেও অবস্থার বদল প্রয়োজন। কিন্তু সুচেতনা নিম্নগামিনী। সমাজের শিক্ষিত স্তরটি সচেতন হইলে ক্রমে তাহার প্রভাব অন্যত্রও পড়িবে।