দেখিয়া যেমন মনে হয়, অনেক কিছুই আসলে তেমন নহে। যুগযুগান্তর ধরিয়া মানুষ এই সতর্কবাণী শুনিয়াছে এবং ভুলিয়াছে। অথচ বাহিরের চাকচিক্য অথবা আস্ফালনে বিভ্রান্ত না হইয়া মন দিয়া দেখিলে এবং বিচার করিলেই মলাট খুলিয়া সত্য প্রকাশ হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁহার চালচলন দর্শন করিলে এবং কথাবার্তা শ্রবণ করিলে এই বিশ্বাস জন্মাইতে বাধ্য যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুল্য প্রবল নেতা নরেন্দ্র মোদীর ভারতেও খুব বেশি নাই। অধুনা নানাবিধ কারণে দীপ্তিরাশিতে কিঞ্চিৎ ছায়া ঘনাইতেছে বটে, তবু শাহরুখ-সম্ভাষণ হইতে কপিলমুনি-বন্দনা— কী দাপট! কিন্তু দাপট দেখাইলেই নেত্রী হওয়া যায় না। নেতা বা নেত্রীর কাজ কী, নেতৃ শব্দেই তাহার স্পষ্ট নির্দেশ আছে। শব্দটি ‘নী’ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন। নী অর্থ নয়ন করা অর্থাৎ লইয়া যাওয়া। নেতৃ তিনিই, যিনি অন্যদের পথ দেখাইয়া লইয়া যান।
কাজটি বড় সহজ নহে। বহুজন যে পথে চলিতে চাহে, সচরাচর তাহা আলস্যের পথ, হঠকারিতার পথ, সস্তায় বাজিমাত করিবার পথ, আপন কর্তব্য পালন না করিয়া যাবতীয় অধিকার ভোগ করিবার পথ। যিনি যথার্থ নেতা, তাঁহার কাজ এই কুপথ হইতে মানুষকে নিরস্ত করা এবং তাহাদের পরিশ্রমের পথে, নীতির পথে, কর্তব্যপালনের পথে (আ)নয়ন করা। কাজটি কঠিন। প্রথমত, এ কাজ করিতে চাহিলে সর্বাগ্রে নিজেকে প্রস্তুত করিতে হয়। দ্বিতীয়ত, বহু মানুষকে এই পথে আনিবার জন্য ধৈর্য এবং শ্রমের প্রয়োজন হয়, অনেক সময়েই জনমনোরঞ্জনের বিপরীতে হাঁটিতে হয়, এমনকী বহু মানুষের— আপন অনুগামীদেরও— অসন্তোষ উৎপাদন করিতে হয়। নেতৃত্বের সরণি কুসুমাস্তীর্ণ নহে, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী বা নেলসন ম্যান্ডেলারা তাহা বিলক্ষণ জানিতেন। মানুষ কী চাহিতেছে, সেই অনুসারে আপন পথ স্থির করা নেতা বা নেত্রীর কাজ নহে, মানুষের কী চাওয়া উচিত, তাহা দেখাইয়া দেওয়াই তাঁহার কাজ।
নেতৃত্বের এই প্রাথমিক শর্ত পূরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যর্থ। তিনি জনসাধারণকে পথ দেখান না, জনসাধারণ যে পথে চলিতে চাহেন তিনি সেই পথে চলেন। তাঁহার জনপ্রিয়তা অবিরত জনমনোরঞ্জনের ফসল। সিঙ্গুরের আন্দোলন হইতে শুরু করিয়া টলিউড-বলিউড-টেলিউড ভজনা, বিষাক্ত চোলাই মদে মৃতদের জন্য ক্ষতিপূরণ হইতে ‘বাসভাড়া বাড়ানো চলিবে না’, সর্বক্ষেত্রেই তিনি জনতার মন ভুলাইয়া জনসমর্থন সংগ্রহ করেন। বস্তুত, তাঁহার নীতি কী, ‘এজেন্ডা’ কী, কখনওই জানা যায় নাই, কারণ তাঁহার ওই সব বস্তুর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, আমজনতা যাহা চাহে বলিয়া তিনি মনে করেন, উহাই তাঁহার নীতি, তাঁহার এজেন্ডা। জনপ্রিয়তার এই নিরন্তর সন্ধানেই মুখ্যমন্ত্রী ক্রমাগত রাজ্য সরকারের ছুটির তালিকা বাড়াইয়া চলিয়াছেন। ২০১১ হইতে ২০১৫, চার বছরে সরকারি ছুটির সংখ্যা বছরে ২৭ হইতে বাড়িয়া ৩২ হইতেছে, আগামী বছর দুর্গাপূজায় টানা এগারো দিন, কালীপূজা-দেওয়ালিতে টানা ছয় দিন সরকারি কাজ বন্ধ থাকিবে। ছুটিপ্রিয় বঙ্গবাসী তাঁহার উপর পরম প্রীত হইবেন। প্রীতি হইতে ভোট আসে, ভোট আসিলে রাজ্যপাট দীর্ঘায়িত হয়। আরও কিছু সময় হাতে পাইলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই ক্যালেন্ডারের বাকি তারিখগুলিকেও লাল কালিতে রাঙাইয়া দিতে সক্ষম হইবেন। নেতৃত্বের রক্তিমা সম্পূর্ণ হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy