একটি নূতন সামাজিক ন্যায়বিচার বেঞ্চ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত লইয়াছে সুপ্রিম কোর্ট, যাহার কাজ হইবে শিশু, মহিলা ও সমাজের বঞ্চিত মানুষদের ন্যায়প্রাপ্তির সমস্যার নিরসন। প্রতি শুক্রবার এই বেঞ্চ বসিবে দুই বিচারপতির এজলাসে। জনস্বার্থ বিষয়ক বিভিন্ন মামলাও অতঃপর এই বেঞ্চের কাছেই পাঠানো হইবে। আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয় বলিয়া মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিশেষত যখন প্রতিটি আদালতে বকেয়া মামলার পাহাড় জমিতেছে এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও বঞ্চনার আইনি প্রতিকারের সম্ভাবনা কার্যত সেই ভিড়ে চাপা পড়িয়া যাইতেছে। একই সঙ্গে রাজ্যে-রাজ্যে হাইকোর্ট এবং জেলা স্তরের আদালতগুলিতে বিচারের মানও সর্বদা প্রশ্নাতীত থাকিতেছে না। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতগুলির রায়ে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরা প্রায়শ ন্যায়বিচারের আশায় শীর্ষ আদালতের দরজায় কড়া নাড়িতেছেন। প্রধান বিচারপতিও মনে করেন, দেশের শীর্ষ আদালত সমগ্র দেশের ন্যায়বিচারপ্রার্থী জনতার দিক হইতে মুখ ঘুরাইয়া থাকিতে পারে না। সমাধান দরকার। তাই এমন নিদান।
হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতগুলির বিচারের মান প্রশ্নযোগ্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাই বলিয়া সুপ্রিম কোর্টেই সব প্রশ্নের শেষ উত্তর, এমন ভাবনার মধ্যে একটা গোড়ার গলদ রহিয়াছে। ‘সুপ্রিম’ যদি সর্বজনীন হয়, তবে তাহা আর ‘সর্বোচ্চ’ হইবে কী করিয়া? অথচ আদি ভারতীয় গণতন্ত্র কিন্তু ভাবিয়াছিল, যে ক্ষেত্রগুলি একেবারেই ব্যতিক্রমী রকমের জটিল ও যেখানে আইনের পুনর্বিচার কাম্য, সেই সব ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া যাইবে। কিন্তু ছোট হইতে মাঝারি, সব মামলাই যদি দিল্লি অভিমুখে রওনা হয়, তবে বিবিধ বিভিন্ন বেঞ্চ তৈরি করিয়াও কূল পাওয়া যাইবে কি? যে-কোনও জনস্বার্থ মামলার বিচারে দুই বা তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ গড়িয়া দিলেই সমস্যা মিটিবে কি? বরং ভাবা দরকার, আদৌ কেন আলাদা বেঞ্চ তৈরি হইবে? সুপ্রিম কোর্টে কেন কেবল ব্যতিক্রমী মামলাগুলিই যাইবে না, এবং কেন সেখানে প্রতিটি মামলাই ‘ফুল বেঞ্চ’ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ বিচারের পর্যায়ে থাকিবে না? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এই মহিমা রক্ষার জন্য যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। যে কোনও গণতন্ত্রে বিচারব্যবস্থা অতি গুরুতর একটি স্থান অধিকার করিয়া থাকে, এবং যে কোনও উৎকর্ষমুখী বিচারব্যবস্থায় আদালতের নিজস্ব ক্ষেত্র নিরূপণ একটি জরুরি কাজ বলিয়া গণ্য হয়। সুপ্রিম কোর্ট-কে স্বল্পসংখ্যক মামলা, ও ফুল বেঞ্চ বিচারের অধিকার-সহ ‘সুপ্রিম’ থাকিতে দেওয়া প্রথম প্রয়োজন। দ্বিতীয় প্রয়োজন, সুপ্রিম কোর্টের নিম্ন স্তরে, অর্থাৎ প্রাদেশিক স্তরে, রাজনৈতিক পক্ষপাত বন্ধ করিয়া, অসংখ্য শূন্য পদ পূর্ণ করিয়া মামলার সংখ্যা ও চাপ হ্রাস করা। নিচু তলার বিচারপ্রক্রিয়া ও তাহার মান ন্যায়পূর্ণ না হইলে তাহার রায়ে অখুশি ন্যায়প্রার্থীরা উত্তরোত্তর সুপ্রিম কোর্টে পাড়ি দিবেনই।
অবস্থাগতিকে আঞ্চলিক সুপ্রিম কোর্ট গড়িয়া আরও এক সমাধানের কথা ভাবা যাইতে পারে। আঞ্চলিক সুপ্রিম কোর্টগুলি হাইকোর্টে অমীমাংসিত জনস্বার্থ মামলা হাতে লইতে পারে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে হাইকোর্টের উপরে আর একটি স্তর তৈরির সমস্যাও আছে, এবং সেই নূতন মধ্যবর্তী আদালতের কাজের মান রক্ষার প্রশ্নটিও আবারও উঠিবার সম্ভাবনাও আছে। মোট কথা, কিছু ক্ষেত্রে সমাধানের রাস্তাটি সহজ নহে, দ্রুতও নহে। নিত্যনূতন বেঞ্চ খুলিলেই সে রাস্তা তৈরি হইয়া যাইবে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে একটি মর্যাদাময় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিতে হইলে অকিঞ্চিৎকর খুঁটিনাটি হইতে তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিবার দায়টি নিম্ন আদালতগুলিকেই লইতে হইবে।