Advertisement
E-Paper

নামকীর্তন

একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা জরুরি হইয়া পড়িয়াছে? তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হউক। একটি ধর্মালোচনা ও ধর্মপ্রব্রজনের স্থান হইলে ভাল হয়? তবে একটি ধর্মস্থান তৈরি হউক। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই কি একটি ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ খোলা অত্যাবশ্যক বলিয়া স্বীকার করা যায়? আপাতত আটশত বৎসর পর নূতন করিয়া নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবার ঘটনাকে ঘিরিয়া ধুমধাম আড়ম্বর আহ্লাদের সীমা নাই। দেশবিদেশ হইতে শুভেচ্ছবার্তা। মহাপণ্ডিত মহানাগরিকদের আশীর্বাণী। কেন এই বিশেষ আহ্লাদ, বোঝা দায়।

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা জরুরি হইয়া পড়িয়াছে? তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হউক। একটি ধর্মালোচনা ও ধর্মপ্রব্রজনের স্থান হইলে ভাল হয়? তবে একটি ধর্মস্থান তৈরি হউক। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই কি একটি ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ খোলা অত্যাবশ্যক বলিয়া স্বীকার করা যায়? আপাতত আটশত বৎসর পর নূতন করিয়া নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবার ঘটনাকে ঘিরিয়া ধুমধাম আড়ম্বর আহ্লাদের সীমা নাই। দেশবিদেশ হইতে শুভেচ্ছবার্তা। মহাপণ্ডিত মহানাগরিকদের আশীর্বাণী। কেন এই বিশেষ আহ্লাদ, বোঝা দায়। একটি পুরাতন ক্যাম্পাস আট শতকের ইতিহাস-সাগর অতিক্রম করিয়া ‘ফিরাইয়া আনা’ নিশ্চয় সম্ভব নয়, বাঞ্ছিতও নয়। তবে কি ইহা কেবল একটি নামের মাহাত্ম্য? যদি তাহাই হয়, তবে আরও গুরুতর প্রশ্ন, কেবল নাম-মাহাত্ম্যেই তবে কেন্দ্রীয় সরকারের এত কোটি টাকা খরচের সিদ্ধান্ত? নাগরিকের কর-প্রদত্ত অর্থ এই ভাবে নাম-মাহাত্ম্যে উড়াইয়া দেওয়া কি সমর্থনযোগ্য? না। বস্তুত, উদ্যোগটি আপত্তিকর। উদ্বেগজনকও। ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ও রাজনীতি বহিঃপ্রতীককে কতখানি গুরুত্ব দিতে পারে, সেই উদ্বেগ।

নালন্দা নামে যদি কোনও আন্তর্জাতিক জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র কিংবা সংস্কৃতির আদানপ্রদান ক্ষেত্রের কথা ভাবা হইত, হয়তো তাহার যৌক্তিকতা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হইত। বিশ্বভারতীও এক দিন এশীয় জ্ঞানচর্চা ও আদানপ্রদানের কেন্দ্র হিসাবে প্রস্তুত হইয়াছিল। সেই প্রয়াস সফল হয় নাই, কিন্তু সব প্রয়াসই অসফল হইবে, ভাবা অনুচিত। অতীত দৃষ্টান্ত হইতে শিক্ষা লইয়া, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান কিংবা শীলভদ্র বহু দেশের জ্ঞানান্বেষীর সহিত বিদ্যাচর্চা করিতেন তাহার সম্মানে, দক্ষতর প্রশাসনের মাধ্যমে এমন প্রয়াস হইতে পারিত। কিন্তু এই ধরনের কেন্দ্র গড়িবার পিছনে প্রথম প্রয়োজন ছিল, আন্তর্জাতিক, বিশেষত বৌদ্ধ ধর্মসংস্কৃতিতে উৎসাহী প্রতিবেশী দেশগুলির অংশগ্রহণ। নালন্দা সম্পর্কে প্রাথমিক প্রস্তাবে এই ধরনের আন্তর্জাতিক অর্থসহায়তা পাইবার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও দেশ হইতে বিশেষ অর্থানুকূল্য মিলে নাই। তাই ভারতীয় করদাতাদের অর্থে আরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়িয়া ইতিহাস কীর্তন!

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারই হউক, আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণই হউক, পশ্চাৎমুখী বা ইতিহাসমুখী হইয়া সে কাজ করা যায় না। দৃষ্টি সর্বদা সম্মুখগামী, বিশেষ করিয়া সংস্কার-দৃষ্টি। যে সংস্কারক এই গোড়ার কথাটা বুঝেন না, তাঁহার প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। ইতিহাসকে ফিরাইয়া আনা যায়ও না, সে কাজ করিবার চেষ্টা বা ইচ্ছা শুভফলদায়ীও হয় না, যিনি যত বড় ইতিহাসপ্রেমীই হউন, এই সামান্য কথাটা তাঁহাকে বুঝিতে হয়। অথচ পূর্বতন বা বর্তমান কোনও কেন্দ্রীয় সরকারই তাহা বোঝে বলিয়া মনে হয় না। নালন্দা-উদ্যোগী ইউপিএ’র উত্তরাধিকারী এনডিএ সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা শোনা গিয়াছে, যে সকল স্কুলে দেশের বরেণ্য প্রাজ্ঞ বা পণ্ডিতরা এককালে পড়িয়াছেন, সেই সব স্কুলকে ‘আপগ্রেড’ করা হইবে, তাহাদের উচ্চমানরেখায় উন্নীত করা হইবে। অর্থাৎ আবার একটি পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ একসঙ্গে দুটি প্রশ্ন তুলিয়া দেয়: প্রথমত, বরেণ্য মানুষের স্কুলে অর্থসহায়তা প্রদান যেন তাঁহাদের ছবিতে মালা দেওয়ার মতো: তাহার বদলে বরং বর্তমানের উৎকর্ষমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অর্থসহায়তা ভাল হইত না? দ্বিতীয়ত, তর্কের খাতিরেও কি ভাবা উচিত নয় যে, দেশের সম্ভাবনাময় ছাত্রছাত্রী আর ওই সব বিদ্যালয়ে নাই, বরং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত, পরিব্যাপ্ত: সুতরাং কেবল ইতিহাসস্মৃতি-রঞ্জিত পথে সংস্কারের রথ চালাইয়া ব্যক্তি বা সমষ্টি, কাহার লাভ?

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy