Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

নরেগা বাতিল করার কোনও যুক্তি নেই

গরিব মানুষের সরাসরি ক্ষমতায়নের প্রয়োজন নিয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না, প্রশ্ন হল, কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প বা নরেগা-র বদলে অন্য কোনও দক্ষতর উপায়ে সেই ক্ষমতায়ন সম্ভব কি?শোনা যাচ্ছে, ইউপিএ সরকারের অগ্রণী প্রকল্প, ন্যাশানাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এনআরইজিএ বা ‘নরেগা’) বন্ধ হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী যদিও এক বার বলেছিলেন, নরেগা এখনই বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু গ্রামগঞ্জের খবর রাখেন এমন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, কিছু দিন হল দিল্লি থেকে নরেগার টাকা আসার গতি রীতিমত শ্লথ হয়ে গেছে।

অভিরূপ সরকার
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

শোনা যাচ্ছে, ইউপিএ সরকারের অগ্রণী প্রকল্প, ন্যাশানাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এনআরইজিএ বা ‘নরেগা’) বন্ধ হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী যদিও এক বার বলেছিলেন, নরেগা এখনই বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু গ্রামগঞ্জের খবর রাখেন এমন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, কিছু দিন হল দিল্লি থেকে নরেগার টাকা আসার গতি রীতিমত শ্লথ হয়ে গেছে। বস্তুত, নিকট অতীতে যাঁরা নরেগা প্রকল্পে কাজ করেছিলেন তাঁদের অনেকেই এখনও টাকা পাননি, এক একটা ব্লকে পাঁচ কোটি দশ কোটি করে টাকা বকেয়া পড়ে আছে।

কোনও কোনও অর্থনীতিবিদের মতে নরেগা প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়াই উচিত, কারণ এতে লাভের থেকে লোকসান বেশি। আবার কারও কারও মতে, নরেগা গরিব মানুষের ক্ষমতায়নে এত দিন যেমন একটা বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে, তেমই ভবিষ্যতেও করার সম্ভাবনা রাখে। দু’পক্ষের যুক্তি এবং উত্তর-প্রত্যুত্তরে জমে উঠেছে লড়াই। কিন্তু যেহেতু এটা শুধুমাত্র পণ্ডিতদের তাত্ত্বিক কাজিয়া নয়, কোটি কোটি গরিব ভারতবাসীর ভাগ্যনির্ধারক, তাই এই মনান্তরের ভিত্তি তথা নরেগার ভাল-মন্দ, সুবিধে-অসুবিধের দিকগুলো সকলেরই জানা দরকার।

গোড়াতেই নরেগা নামক প্রকল্পটির মূল কাঠামোটা এক বার স্মরণ করে নেওয়া যাক। এই প্রকল্প অনুযায়ী ভারতীয় গ্রামের প্রতিটি পরিবার সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির বিনিময়ে বছরে একশো দিনের কাজ দাবি করতে পারে। মজুরির টাকার সিংহভাগ আসবে সরাসরি কেন্দ্র থেকে, কিন্তু প্রকল্প রূপায়ণের ভার থাকবে একেবারে তৃণমূল স্তরে পঞ্চায়েতের উপর। ভাবা হয়েছিল, নরেগার কাজ দিয়ে গ্রামীণ পরিকাঠামো তৈরি হবে। আর নরেগার আর্থিক লেনদেনগুলো থাকবে একেবারে স্বচ্ছ। নরেগার খাতে রাজ্যগুলো, জেলাগুলো, এমনকী পঞ্চায়েতগুলোও যে অর্থ পাবে তার পাইপয়সা হিসেব তোলা থাকবে নরেগার ওয়েবসাইটে, যে চাইবে সে-ই সমস্ত হিসেব দেখতে পাবে। সব থেকে বড় সুবিধে, কে গরিব, কে গরিব নয় সেটা বোঝার জন্য আলাদা করে চেষ্টা করতে হবে না। কাজ চাইবার মধ্য দিয়ে গরিব মানুষ নিজেরাই নিজেদের চিহ্নিত করে দেবেন। যদিও নরেগার কাজ গরিব-অগরিব যে কেউ চাইতে পারেন, ধরে নেওয়া হয়েছিল, যে সব কাজ নরেগা দিতে পারবে, যেমন মাটি কাটা, রাস্তা বানানো, পুকুর খনন, সে সব কাজ একটু অবস্থাপন্নরা করতে চাইবেন না।

নরেগার উদ্দেশ্য যে মন্দ ছিল না সে-কথা সকলেই স্বীকার করবেন, এবং যে লক্ষ্য নিয়ে নরেগা শুরু হয়েছিল তার কিছুই যে ছোঁয়া যায়নি এমনও নয়। এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে গ্রামের গরিব মানুষ, পিছিয়ে পড়া জাতি-জনজাতি, মহিলা, এঁদের সকলেরই কিছু কিছু ক্ষমতায়ন নিশ্চয় হয়েছে। শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষমতায়ন নয়, গরিব মানুষের হাতে, বিশেষ করে গরিব মহিলাদের হাতে, কিছু টাকা আসার ফলে পরিবারের বাচ্চাদের ইস্কুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটেছে। এর একটা দীর্ঘমেয়াদি ফল তো আছেই। তা ছাড়া, বছরের যে সময়ে গ্রামে চাষের কাজের আকাল, তখন, আগেকার দিন হলে, পেটের তাগিদে পরিবারের পুরুষদের, কখনও বা মহিলাদেরও, ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হত। পারিবারিক বন্ধনে ফাটল ধরত, শিশুদের সুষ্ঠু ভাবে বেড়ে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াত। নরেগা আসার ফলে অকাজের মরসুমেও কাজ পাওয়া যাচ্ছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাড়িঘর ছেড়ে কর্মান্বেষণে আর দূরদেশে যেতে হয় না। সব থেকে বড় কথা, শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করতে পারছেন বলে গরিব মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, নিজের প্রতি মর্যাদা বেড়েছে। নরেগার মধ্যে দিয়ে গরিব মানুষের যে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে তার বড় প্রমাণ, সরকার নরেগা প্রকল্প চালু করার পরে গ্রামে শ্রমিকদের মজুরি উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে এবং তার জেরে মজুরি বেড়েছে শহরের শ্রমিকদেরও।

এত সব সত্ত্বেও, নরেগার থেকে যতটা আশা করা গিয়েছিল তার একটা ভগ্নাংশ হাসিল করা গেছে মাত্র। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানতে পারছি, নরেগায় যাঁরা কাজ চেয়েছেন তাঁদের অর্ধেকেরও বেশি কাজ পাননি। এবং, কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অগরিবদের তুলনায় প্রকৃত গরিবদের নরেগায় কাজ পাবার প্রবণতা বা সম্ভাবনা খানিকটা কম। উপরন্তু, নরেগার কাজ বিতরণের সময় রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব প্রায়শই লক্ষ করা গেছে।

নরেগার কারণে গ্রামে মজুরি বেড়েছে এটা সত্যি, কিন্তু তার সঙ্গে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা তেমন একটা বাড়েনি। ফলে চাষবাস ক্রমশ অলাভজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিশেষত মাঝারি ও ছোট মাপের চাষিদের কাছে, যাদের ফসল বোনার ও তোলার মরসুমে কিছু শ্রমিক ভাড়া করতেই হয়। তা ছাড়া, নরেগার সমালোচকরা বলছেন, এই প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে সম্পদগুলো তৈরি হচ্ছে— জলাশয়, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঁধ— তাদের মান তেমন ভাল নয়। এর একটা বড় কারণ, নরেগায় শ্রমের জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বটে, কিন্তু ভাল মালমশলা কেনার জন্য যতটা টাকা প্রয়োজন ততটা টাকা বরাদ্দ করা হয়নি। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, যতই আটঘাট বেঁধে শুরু করা হোক না কেন, নরেগা যে তার লক্ষ্য থেকে কিছুটা ভ্রষ্ট হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

কিন্তু তার মানে কি নরেগা প্রকল্পটিকে একেবারে তুলে দিতে হবে? যাঁরা মনে করেন, দেশে আর্থিক বৃদ্ধি হলে সে বৃদ্ধির সুফল নিজের থেকেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে সমাজের দরিদ্রতম ব্যক্তিটির কাছে পৌঁছে যাবে, আমরা তাঁদের দলে নই। আমাদের বিশ্বাস, আর্থিক বৃদ্ধির সুফল পেতে গেলে গরিব মানুষকে বাজার অর্থনীতির যোগ্য হতে হবে। তাঁকে লেখাপড়া শিখতে হবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। এ সবের জন্য আবার সরাসরি গরিব মানুষের আর্থিক ক্ষমতায়ন দরকার। নরেগায় ত্রুটি থাকলেও এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে গরিব মানুষদের হাতে টাকা আসছিল, তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে পাঠাচ্ছিলেন, কিছুটা পুষ্টিকর খাবারদাবার খাওয়াতে পারছিলেন। নরেগা উঠে গেলে গরিব মানুষের ক্ষমতায়ন আরও কঠিন হবে।

বস্তুত, গরিব মানুষের সরাসরি ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না, প্রশ্ন হল, নরেগার বদলে অন্য কোনও দক্ষতর উপায়ে গরিব মানুষের সরাসরি আর্থিক ক্ষমতায়ন সম্ভব কি? গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে যে অন্যতম প্রধান উপায়ে গরিব মানুষের ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে তার ইংরেজি নাম কন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার বা সংক্ষেপে সিসিটি। ব্রাজিলে প্রথমে েবালসা এসকোলা ও পরে েবালসা ফামিলিয়া নাম দিয়ে বড় আকারে শুরু হয়েছিল সিসিটি, পরে নানা নামে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সিসিটি-র মূল কথা হল, গরিব মানুষ বা গরিব পরিবারের কাছে সরাসরি আর্থিক অনুদান পৌঁছে দিতে হবে। এবং এর জন্য সেই গরিব মানুষ বা পরিবারটিকে পালন করতে হবে কিছু কিছু পূর্ব আরোপিত শর্ত। যেমন, েবালসা ফামিলিয়া প্রকল্পে অনুদান পেতে গেলে একটি পরিবারের ছয় থেকে পনেরো বছর বয়স্ক প্রত্যেকটি বাচ্চাকে ইস্কুলে নাম লেখাতে হয়, ছয় বছরের কম বাচ্চাদের কিছু কিছু অত্যাবশ্যক টিকা নিতে হয়। সিসিটির দুটো সুবিধে। এক, এর মধ্যে দিয়ে সরাসরি গরিবদের আর্থিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে। দুই, শর্তগুলি মানার ভিতর দিয়ে গরিব পরিবারদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটছে। আমাদের দেশে যাঁরা নরেগার বিরোধী তাঁরা বলছেন নরেগার বদলে এখানে বড় আকারে সিসিটি চালু করা হোক, আর নরেগার মধ্য দিয়ে যে সম্পদগুলো তৈরি করার কথা ভাবা হয়েছিল সেগুলির ভার সরাসরি সরকারের বিভিন্ন দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হোক।

নরেগা না সিসিটি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এই দুই কার্যকলাপের একটা তুলনামূলক আলোচনা প্রয়োজন। নরেগা বা সিসিটি দুটি ব্যবস্থাই ব্যাঙ্ক অথবা পোস্টাপিসের মধ্য দিয়ে কাজ করে, অনুদানের টাকা সরাসরি জমা পড়ে গ্রহীতার ব্যাঙ্ক বা পোস্টাপিসের অ্যাকাউন্টে। আমাদের দেশে যেহেতু গরিবদের একটা বড় অংশকে এখনও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়নি, তাই নরেগা ও সিসিটি দুইয়েরই রূপায়ণে সীমাবদ্ধতা থেকে গেছে। কিন্তু সিসিটি চালাতে গেলে শুধু তো ব্যাঙ্ক নয়, গ্রামে গ্রামে ইস্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকা দরকার। না হলে সিসিটির শর্তাবলি গরিব মানুষ পালন করবেন কী করে? দরিদ্রতমরা প্রত্যন্ত গ্রামেই বাস করেন। সেখানে ঠিকমত পরিকাঠামো তৈরি না হলে যাঁদের সব থেকে বেশি দরকার তাঁরাই সিসিটি প্রকল্পগুলি থেকে বাদ পড়ে যাবেন।

দ্বিতীয় সমস্যা দরিদ্র-চিহ্নিতকরণের। সিসিটি ব্যবস্থাকে মোটের উপর দরিদ্রদের সরকারি তালিকার ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা জানি, সেই তালিকায় অনেক গলদ আছে। অনেক প্রকৃত গরিব মানুষের সেখানে জায়গা হয় না, আবার বহু অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন পরিবার দরিদ্রদের তালিকায় নিজেদের নাম ঢুকিয়ে দিয়ে সরকারি সুযোগসুবিধে পেয়ে যায়। কিছু সিসিটি প্রকল্প ভাল চলছে, কারণ সেখানে সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরির কাজটা কোনও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব। যেমন পশ্চিমবঙ্গে কন্যাশ্রী প্রকল্পটি; এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনুদান প্রাপকদের তালিকাটি ইস্কুলগুলোই তৈরি করে দিচ্ছে, ফলে এখানে অপাত্রে টাকা খরচ হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু নরেগার পরিবর্ত হিসেবে সিসিটি ব্যাপক ভাবে চালু করতে গেলে কোনও না কোনও দরিদ্র-তালিকার উপর নির্ভর করতেই হবে, যা ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য। তুলনায় নরেগা-য় দরিদ্ররা অনেকটা নিজেরাই নিজেদের নির্বাচন করে নিচ্ছেন। এর বাইরেও যে কেউ কেউ অন্যায্য ভাবে সুবিধে পাচ্ছেন তা আমরা আগেই বলেছি। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতা সরাসরি দরিদ্র-তালিকা তৈরির সীমাবদ্ধতার তুলনায় কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সব থেকে বড় কথা, এক জন গরিব মানুষ যখন কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করছেন তখন তাঁর আত্মমর্যাদা বাড়ছে, নিজের ওপর আস্থা বাড়ছে। নরেগা সেই আস্থা, সেই আত্মমর্যাদা তাঁকে দিচ্ছে। একতরফা অনুদান, যেটা সিসিটি-র মূল কথা, সেই আত্মমর্যাদা গরিব মানুষকে দিতে পারে না। সব মিলিয়ে মনে হয়, নরেগাকে একেবারে বাতিল করে দেবার সময় আমাদের দেশে এখনও আসেনি।

কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abhirup sarkar editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE