Advertisement
E-Paper

প্রাণের মর্যাদা

স্কুলবাস একটি প্রৌঢ়কে ধাক্কা দিবার পর, সেই মানুষটির দেহ বাসেই তুলিয়া লওয়া হইল। হাসপাতাল পৌঁছাইয়া দিবার জন্য নহে, ‘ঝামেলা’ এড়াইবার জন্য। আহত ব্যক্তি বাসময় ছাত্রীর সম্মুখে মেঝেতে শুইয়া বহু ক্ষণ ধরিয়া কাতরাইতে কাতরাইতে মারা গেলেন, বাসে উপস্থিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছাত্রীদের ধমকাইলেন, ‘কোনও কথা বলবি না বাড়ি গিয়ে।’ পরে উনি বলিয়াছেন, হাসপাতালে ব্যক্তিটিকে লইয়া যাইলে থানা-পুলিশ হইত, উহার বহু ঝঞ্ঝাট, ছাত্রীদেরও বাড়ি ফিরিতে দেরি হইয়া যাইত।

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

স্কুলবাস একটি প্রৌঢ়কে ধাক্কা দিবার পর, সেই মানুষটির দেহ বাসেই তুলিয়া লওয়া হইল। হাসপাতাল পৌঁছাইয়া দিবার জন্য নহে, ‘ঝামেলা’ এড়াইবার জন্য। আহত ব্যক্তি বাসময় ছাত্রীর সম্মুখে মেঝেতে শুইয়া বহু ক্ষণ ধরিয়া কাতরাইতে কাতরাইতে মারা গেলেন, বাসে উপস্থিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছাত্রীদের ধমকাইলেন, ‘কোনও কথা বলবি না বাড়ি গিয়ে।’ পরে উনি বলিয়াছেন, হাসপাতালে ব্যক্তিটিকে লইয়া যাইলে থানা-পুলিশ হইত, উহার বহু ঝঞ্ঝাট, ছাত্রীদেরও বাড়ি ফিরিতে দেরি হইয়া যাইত। কেবল কিছু অবান্তর দীর্ঘস্থায়ী এ বিরক্তিকর প্রক্রিয়া এড়াইবার কারণে তিনি একটি ব্যক্তিকে মারিয়া ফেলিবার প্রক্রিয়ায় শামিল হইলেন। এই সমাজে সর্বব্যাপ্ত শিক্ষা: ঝামেলা এড়াইয়া বাঁচো, অন্য মানুষ মরিলে মরুক— তাহাকেই আরও পুষ্ট করিলেন। ইহা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে, প্রায় প্রতিটি মানুষই পথদুর্ঘটনা দেখিয়া আহতদের লইয়া হাসপাতালে ছুটিবার পরিবর্তে আহতদের এড়াইয়া পাশ কাটাইয়া ছুটিতে ব্যস্ত। না-দেখিতে পাওয়া এই সমাজের আয়ত্ত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পথের ধারে বসিয়া বসিয়া মরিয়া যান, মানুষেরা ডিঙাইয়া যায়; মস্তানদল বাজারের ভিতর ছুটিয়া নিরীহ মহিলাকে ধরিয়া যৌন নিগ্রহ করিলে এই মহান জাতি পুঁইশাক ওজনে ব্যস্ত হইয়া পড়ে। এইগুলি ঘটিলে সংবাদপত্র এই রাজ্যের বা শহরের ‘অমানবিক মুখ’ দেখিয়া চমকাইয়া উঠে, কিন্তু এইটিই একমাত্র মুখ, বৃদ্ধা মাতাকে টান মারিয়া বৃক্ষতলে নির্বাসনের আখ্যান ও আদালতে সেই মাতাকে ‘ভাড়াটিয়া ভিখারি’ আখ্যায় ভূষিত করিতে আগ্রহী সন্তানের কাহিনি বাছিতে শহর ও গ্রাম উজাড় হইয়া যাইবে।

এই পরিস্থিতির জন্য দেশের প্রশাসন বহুলাংশে দায়ী। মানুষের মেরুদণ্ড কখনও সচেতনে কখনও অচেতনে ইহারা গুঁড়াইয়া ধূলি করিয়াছে। এই পৃথিবীতে ন্যায় নাই, থাকিলেও অন্তত এই দেশে নাই— ইহা জনমানসে প্রোথিত করিয়াছে। অন্যায় করিয়া সরিয়া পড়িতে পারিলে তাহাতে বাহাদুরি বই আত্মাপমান নাই: প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। সুবিচার সাধারণ মানুষের জন্য নহে, কেবল ক্ষমতাসীন ও তাহার আশ্রয়পুষ্টদের জন্যই সংরক্ষিত, তাহাও বারংবার দেখা গিয়াছে। সমগ্র সমাজে এই যে ধারণা চরম সত্যের ন্যায় ভাসিত: পুলিশের নিকট যাইলে তাহারা সাহায্যের পরিবর্তে অপদস্থ করিবে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া যাইবে— ইহাও তো মানুষের মনগড়া নহে, বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এই প্রবল অনীহা রচিত হইয়াছে। সাধারণ প্রজা যে কোনও ক্ষমতা বা কর্তৃপক্ষকে এমনিই ভয় পাইয়া থাকে। আমাদের সমাজের পুলিশের দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্য, এবং তাহার প্রতি ক্ষমতার অন্তহীন প্রশ্রয় মিলিয়া সেই ভয়কে দৃঢ়তর করিয়াছে। তাই মানুষ ভাবিতেছে, লোকটি মরিতেছে মরুক, আমি কেন এই দায় স্কন্ধে লইয়া জ্যান্তে মরিতে যাই।

তাহার সহিত রহিয়াছে এই বেদ-উপনিষদ-আশ্রয়ী দেশের ‘উচ্চমার্গীয় ঔদাসীন্য’, যাহা প্রাণকে বিশেষ মর্যাদা দিতে উৎসাহী নহে। হাসপাতালে মুর্মূষুকে দেখিবার জন্য মধ্যরাত্রে ডাকিতে যাইলে ডাক্তার ধমক দেন, নার্স ঘুষ না পাইলে সদ্যপ্রসূতিকে ট্রলি হইতে ফেলিয়া দেয়, পথিক জঞ্জালস্তূপের পার্শ্বে মরণোন্মুখ ভিখারিকে দেখিয়া চক্ষু সরাইয়া লয়, তাহার আইপিএল-তর্কে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়ে না। এইখানে জন্মায় বহু, মরেও বহু। প্রাচীন রসিকতা রহিয়াছে, পাতি বলিতেছেন, ভূতোকে বহু দিন দেখিতেছি না, মাতুলালয়ে গিয়াছে? মাতা বলিতেছেন, সে তো গত সনে কলেরায় মারা গিয়াছে। পিতা বলিতেছেন, ও, তাহা হইবে, ঈশ্বর এক দিকে দিতেছেন, এক দিকে লইতেছেন। তৃতীয় বিশ্বের এই বোধি প্রকৃত পক্ষে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, উদ্যমহীনতা এবং জীবন-আড়ষ্টতারই ফল। এই নিড়বিড়ে নীতিশিথিল সমাজে ওই প্রধান শিক্ষক তাঁহার ছাত্রীদের সমঞ্জস শিক্ষাই দিয়াছেন।

য ৎ কি ঞ্চি ৎ

পুজোর মুখে মুখে মানুষ এমনিই উত্তেজিত, তার ওপর সারদা রিয়েলিটি শো জমে উঠেছে। একে ঘিরে জমুক ব্যবসা। সোমবার কে ধরা পড়বে মঙ্গলে কাকে ডেকে পাঠানো হবে, তাই নিয়ে বেটিংও-চক্র গড়া হোক না, দু’পয়সা আসে। হাসপাতালে খোলা হোক ‘রহস্যময় বুকব্যথা ওয়ার্ড’, রোগী বাড়বে বই কমবে না। শপিং মল-এও চালু হোক সারদা সেল: একটা কিনলে তেত্তিরিশটা ফ্রি, কিন্তু বেরোবার সময় গেটে পিঁপিঁ ও দারোয়ান খপাৎ, তখন বলব চিনি না তো!

anandabazar editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy