পশ্চিমবঙ্গে এখন শুধুই পাল্টা দানের খেলা। তুমি যাদবপুরের উপাচার্যের বিরুদ্ধে মিছিল করিলে কেন? তাহা হইলে আমিও তাঁহার সমর্থনে পাল্টা জনজোয়ার ডাকিব। কার্যক্ষেত্রে সে জোয়ার যতই অস্ফুট বুদ্বুদসম প্রতিভাত হউক না কেন, মিছিল তো হইল! তুমি চিট ফান্ডের প্রতারণার বিরুদ্ধে মিছিল ডাকিলে? বেশ, আমি এখনই সরকারবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা মিছিল ও ধর্নার ডাক দিব। তুমি আলু-ব্যবসায়ী, আমার নির্ধারিত দামে ক্ষতি স্বীকার করিয়াও আলু বিক্রয় করিবে না? এখনই পাল্টা দিব, প্রয়োজনে ট্রাক আটকাইয়া আলু মিলনমেলায় আনিয়া সরকারি ভাবে বিক্রয়ের বন্দোবস্ত করিব, না পারিলে ধাপার মাঠে পাঠাইয়া দিব। কয়েক টন আলু পচিল বটে, কিন্তু বেয়াড়া ব্যবসায়ীগুলার পাল্টা শিক্ষা হইল! তুমি সংক্রমণের কারণকে জ্বর না বলিয়া এনসেফ্যালাইটিস দেখাইলে? এখনই পাল্টা দিব, তোমার হাত হইতে যাবতীয় দায়দায়িত্ব কাড়িয়া লইব। পাল্টা দানের এই খুচরো খেলা তাস, দাবার আসরে চলিতে পারে। কিন্তু এখানে রণনীতির মহাকাব্যিক বিস্তার নাই, শেষ অবধি হেক্টর বধ বা দুঃশাসনের রক্তপান কিছুই ঘটে না। তাহা সম্ভবও নহে। প্রাকৃত শব্দ পলট্ট হইতে আমদানিকৃত পাল্টা নামক বিশেষ্য পদটি বাংলার নিজস্ব অভিজ্ঞান। কবিগানে অন্য পক্ষকে উত্তর দানের নামই পাল্টা। তরজা-সংস্কৃতি বেয়েই বঙ্গভাষায় প্রত্যুত্তর শব্দের অর্থ: পাল্টা জবাব। পাল্টার রাজনীতি তাই বিশ্ববঙ্গের অনন্য ঐতিহ্য। বাংলাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দান করিবার লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সেই ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক হইবেন, ইহাতে আর আশ্চর্য কী!
পাল্টার অন্যতম বৈশিষ্ট্য: বিরোধীকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। প্রাচীন কালে রাজানুগ্রহ লাভের ক্ষেত্রে কবির নিজস্ব কাব্যকৃতিই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু তরজায় শুধু কাব্যকৃতি নহে, গায়িকা যজ্ঞেশ্বরীকে জগা বা ভোলানাথকে ভোলা ময়রা বলিয়া তুচ্ছ করার ক্ষমতাই প্রধান। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি হইতে রায়গঞ্জ, যাদবপুর সবই যখন সাড়ে তিন বছর ধরিয়া একাদিক্রমে তুচ্ছ ঘটনার অভিধা পায়, তাহাকে আর রাজনীতি বলা যায় না। শাসকের রাজনীতিতে মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তারের ব্যাঞ্জনা থাকে, পাল্টা দেওয়ার তরজা সংস্কৃতি নহে। বাম জমানার অন্তিম পর্বে ‘আমরা বনাম ওরা’ বা নন্দীগ্রামকাণ্ডের পাল্টা মিছিলেও সেই আধিপত্য বিস্তারের দুর্বল রেশ ছিল। সব কিছু তুশ্চু জ্ঞান করিবার তরজা গাওয়া হইত না। নির্বিচারে ক্যাডার নামাইয়া বিরোধীদের একই মুদ্রায় শোধ দেওয়া হইত। ভ্রান্ত আদর্শ বরাবর বিরোধিতাকে চক্রান্ত বলিয়া প্রমাণ করিতে চাহে। কিন্তু তরজা-সংস্কৃতি সেই পরিশ্রমটুকুও স্বীকার করে না, বিরোধিতাকে কুৎসা বলিয়া খেউড় গানের আসর জমানোই তাহার একমাত্র লক্ষ্য।
পাল্টার এই জনসংস্কৃতিতে পাল্টি খাওয়াই রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। পাল্টানো মানে নিছক পরিবর্তন নহে, আরও কিছু। বাংলা ব্যাকরণের পরীক্ষায় নম্বর পাইবার জন্য পড়ুয়াদের বিপরীতার্থক শব্দের তালিকা মুখস্থ করিতে হয়। কিন্তু সেই তালিকায় সকল শব্দের প্রবেশ থাকে না। সব শব্দের বিপরীত হয় না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবং সমাজ এই সীমার অবসান চাহিতেছে। সে মনে করে, সব কিছুর বিপরীত চাই। সে প্রশ্ন তোলে, তুমি মিছিল করিলে আমি পাল্টা দিব না কেন, তুমি সিপিএমত্ব দেখাইলে আমিই বা কেন তৃণমূলত্ব দেখাইব না। তুমি অধম হইলে আমি পাল্টা অধমতর হইব না কেন। কথা একটিই। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস বা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের বাংলা ভাষায় পালট বা পাল্টা শব্দটি নিছক পরিবর্তনকে বুঝায় না। তাহা এক বিশেষ পরিবর্তন: পশ্চাতে ফেরা। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয় বাংলার এই ভাষা-সংস্কৃতি বিস্মৃত হন নাই!
য ৎ কি ঞ্চি ৎ
ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ক্যাম্পেনের ই-ব্রশিয়োরগুলো যে ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভে বিতরণ করা হল, সেগুলো উলটে দেখা গেল, সব ‘মেড ইন চায়না’। আধুনিক পৃথিবীতে ফোন, টিভি, জিরে, সরষে, শালগ্রাম শিলা— সমস্তই চিনে তৈরি, তাই ব্যাপার খুব লজ্জার নয়, তবু খেলতে নেমেই পা হড়কে গেল। ইগোয় পেল্লায় আঘাত পেয়ে, হয়তো সামনের বছর দেশি নির্মাণবাবুরা আর কিচ্ছুই তৈরি করবেন না, স্রেফ রাশি রাশি ফ্ল্যাশ-ড্রাইভ! তা হলে ব্রিজ কে গড়বে? কেন, চিন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy