কলিকাতার স্নায়ুকেন্দ্র ধর্মতলার ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে রাস্তা জুড়িয়া সমাবেশ করার জন্য বিরোধী দল সিপিআইএমের দাবি কলিকাতা পুলিশ খারিজ করিয়া দিয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে ইহাতে কোনও গোল নাই। একটি জনবহুল মহানগরীর ব্যস্ততম রাস্তা জুড়িয়া কাজের দিন সমাবেশ আয়োজনের যে কোনও দাবিই খারিজ করিয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু সেই যুক্তিতে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে বর্তমান শাসক দলের ২১ জুলাইয়ের সভার অনুমতিও দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রতি বছর পুলিশ দিব্য সেই অনুমতি দেয়, এ বছরেও দিয়াছে। পুলিশের বক্তব্য, কেবল তৃণমূল কংগ্রেসকে ওই বিশেষ দিনটিতে ওই স্থানে সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়, অন্য কোনও দল বা সংগঠনকে তাহা দেওয়া যাইবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের বেলায় এই ব্যতিক্রম কে? পুলিশের জবাব, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশটি একটি ঐতিহ্যে পরিণত, তাহার সহিত অন্য সমাবেশের তুলনা চলে না।
কীসের ঐতিহ্য? কত দিনের ঐতিহ্য? ইহা কি ওয়াজেদ আলি কথিত অর্ধালোকিত গ্রামীণ চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া কথকের রামায়ণ পাঠের মতো সুদীর্ঘ ‘ট্র্যাডিশন’, যাহা সমানে চলিতেছে এবং চলিবে? ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার মতো দীর্ঘ কাল তো তৃণমূল কংগ্রেস দল রাজ্য-রাজনীতিতে প্রাদুর্ভূতই হয় নাই। তাহার দ্বারা কোনও ঐতিহ্য স্থাপন কেমন করিয়া সম্ভব, আর পুলিশই বা সেই ‘ঐতিহ্য’ রক্ষা করিতে এত তৎপর কেন? দ্বিতীয় কথা হইল, ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে রাস্তা অবরোধকারী জনসমাবেশ যদি ঐতিহ্য হয়, তাহা একটি নেতিবাচক ঐতিহ্য, যাহা শহরের অন্য সব সমাবেশের মতোই জনসাধারণের দুর্ভোগ ডাকিয়া আনে এবং রাজধানীর একটি কাজের দিন উচ্ছন্নে যায়। ইহা কি এমন কোনও ঐতিহ্য, যাহা যত্নসহকারে লালন করা উচিত? পুলিশের কাজ ঐতিহ্য রক্ষা নয়, তাহার কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, শহরকে অবরোধ ও যানজটমুক্ত রাখা। সে জন্যই পুলিশ বেতন পায় এবং জনসাধারণের দেয় করের টাকা হইতেই সেই বেতন হয়, কোনও দলীয় তহবিল হইতে নয়। পুলিশকে তাহার ইতিকর্তব্য সুষ্ঠু ভাবে পালন করিতে হইলে, বাছাবাছি না করিয়া শাসক-বিরোধী নির্বিশেষে সব দলকেই পথ-অবরোধ হইতে নিরস্ত করিতে হইবে। ঐতিহ্য কিংবা প্রথার নামে কাহাকেও ছাড় দিলে চলিবে না।
এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব অবশ্যই পূর্ববর্তী জমানার উত্তরাধিকার। তখনও শাসক বামপন্থীরা যথেচ্ছ রাস্তা জুড়িয়া মিটিং-মিছিল করিলেও বিরোধীদের বেলা ‘পৃথক ফল’ হইয়াছে, তখনকার পুলিশকেও সভা-সমাবেশ আয়োজনের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য করিতে দেখা গিয়াছে। সেই হিসাবে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভার অনুমতি দেওয়া ও না-দেওয়ার ঘটনাটি নূতন নয়। অভিনব যাহা, তাহা হইল পুলিশের ঐতিহ্যপ্রিয়তা। কলিকাতা পুলিশ যথার্থ ঐতিহ্যসচেতন হইলে অবশ্য এই ঐতিহাসিক শহরের অনেক হেরিটেজ ভবন সমাজবিরোধীদের আখড়া হইয়া উঠিত না, হগ মার্কেটের চারপাশ এমন নরকে পরিণত হইত না। শাসক দলের ঐতিহ্য লইয়া পুলিশের ভাবিত হওয়ার কোনওই দরকার নাই। বরং কলিকাতাকে মিছিল-সমাবেশের অবরোধ হইতে মুক্ত করার জন্য তাহারা পরিকল্পনা করুক, প্রয়োজনে সেই পরিকল্পনা আদালতে জমা দিক। আদালত তো কবে হইতেই মিছিলনগরীর অপবাদ ঘুচাইয়া কলিকাতাকে একটি বাসযোগ্য, সভ্য শহরে পরিণত করিতে সচেষ্ট।