জম্মু-কাশ্মীরে বন্যার জল নামিতে শুরু করিয়াছে। কিন্তু ছয় দশকের ভয়ংকরতম বর্ষণ, জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন রাজ্যকে যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করিয়াছে, তাহা স্বাভাবিক হইতে বহু সময় লাগিবে। বন্যার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা নিজেদের বহু জলবন্দি মানুষকে উদ্ধার করিয়া নিরাপদ স্থানে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য, পানীয় জল, বস্ত্র ও পলিথিনের আচ্ছাদন বিতরণ করিয়াছেন। কিন্তু এই ধরনের সেবামূলক কাজ বাহিনী দেশের অন্যত্রও, বস্তুত সর্বত্রই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে করিয়া থাকে। কাশ্মীর কোনও ব্যতিক্রম নয়। অথচ সেনার এই ত্রাণকর্তার ভূমিকার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদের আওয়াজ তোলা কাশ্মীরিদের অপরিসীম কৃতজ্ঞতা দাবি করা হইতেছে। জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বাহিনীর ত্রাণের সচিত্র প্রতিবেদন বারংবার তুলিয়া ধরিয়া এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হইতেছে, যেন বাহিনীর, তথা তাহাদের নিয়ামক ভারতীয় রাষ্ট্রনেতাদের এই ‘মহানুভবতা’ বিচ্ছিন্নতাকামী কাশ্মীরিদের একেবারেই প্রাপ্য নয়, তাই অতঃপর উদ্বাহু হইয়া তাঁহাদের জেহাদি দমনে নিযুক্ত বাহিনীকে স্বাগত জানানো উচিত। একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেও যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উপজীব্য করিয়া তোলা যায়, তাহার নিদর্শন এই ঘটনা।
এই সমবেত সেনা-বন্দনার ফলে যাহা নজরের আড়ালে চলিয়া যাইতেছে, তাহা হইল আম কাশ্মীরি জনগণের সাহসী ও নিঃস্বার্থ ত্রাণপ্রয়াস। বন্যার্তদের প্রাণ রক্ষায় স্থানীয় কাশ্মীরি তরুণ, স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠন যে মরণপণ লড়াই চালাইয়াছেন, তাহা এক অলিখিত বীরত্ব ও সাহসিকতার কাহিনি। সেনাবাহিনীকে অকুস্থলে পৌঁছাইয়া উদ্ধারকার্যে সাহায্য করিতেও এই স্থানীয়েরা দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করিয়াছেন। তাঁহাদের শৌর্য ও আত্মত্যাগের ইতিবৃত্ত কিন্তু জাতীয় গণমাধ্যমে অকথিতই। ঠিক যেমন নজরের আড়ালে চলিয়া গিয়াছে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের অপদার্থতা। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সরকার রাজ্যের এত বড় বিপর্যয়ে কার্যত অদৃশ্য। সরকারি দফতর, বিপর্যয় মোকাবিলার বাহিনী, হাসপাতাল সবই জনশূন্য। মুখ্যমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি, প্রশাসন বিপর্যয়ের ভয়াবহতায় বিহ্বল হইয়া পড়ে, সকলেই নিজ-নিজ প্রাণ বাঁচাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়ে। জনসাধারণকে তবে এই ঘোর দুর্দিনে ওমর সরকার কাহার বরাভয় হস্তে সমর্পণ করিয়া অন্তর্হিত হয়? আপনাপন প্রাণ ও পরিবারবর্গকে নিরাপদ করার পরেই বা কেন সরকারি আধিকারিক ও কর্মীরা বন্যা মোকাবিলায় সক্রিয় হন নাই? ওমর নিজেই বা কোথায় আত্মগোপন করিলেন? একটি সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজনের বাহিরে তাঁহাকে তো আর কিছু করিতে দেখা গেল না। স্বভাবতই কাশ্মীরিদের ক্ষোভ ওমর সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত। হয়তো মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহার দল হাল ছাড়িয়া দিয়াছে। নির্বাচনী হাল।
উপত্যকার বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতৃত্বকেও উদ্ধার ও ত্রাণযজ্ঞে অনুপস্থিত দেখা গিয়াছে। তাঁহারা নিজেদের কাশ্মীরিদের ‘স্বাভাবিক নেতা’ দাবি করেন। জনতার এই ক্ষতি ও সর্বনাশের দিনে তাঁহারা কোথায় ছিলেন, এই প্রশ্ন এড়াইবার নয়। পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ভূমিকম্প ও বন্যায় সেখানকার জেহাদি সংগঠন লস্কর-ই-তইবা কিংবা জামাত-উদ-দাওয়া যে সেবামূলক ত্রাণকার্যে জনসাধারণের দুর্গতি মোচনে ঝাঁপাইয়াছিল, হুরিয়তকে ভারতীয় কাশ্মীরের নজিরবিহীন বন্যাবিপর্যয়ে তেমন কিছু করিতে দেখা গেল না কেন? দুর্গতের উদ্ধার ও ত্রাণে অগ্রসর হইলে আম কাশ্মীরিদের মধ্যে তাঁহাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি তো আরও বৃদ্ধি পাইত। অথচ গিলানি-সহ গোটা হুরিয়ত নেতৃত্বই ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ সংবলিত বিবৃতি জারির বাহিরে কোনও সক্রিয়তা দেখাইলেন না। ইহাকে বিস্ময়কর বলিলে কম বলা হয়।