Advertisement
E-Paper

ব্যক্তিগত মত নয়, গবেষণা যা বলে

সন্তানহীন মহিলাদের কৃত্রিম গর্ভস্থাপনের বিরুদ্ধে কোনও কোনও মহল থেকে একটা প্রচার চলছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অন্তহীন সময় লাগে, বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়, প্রচণ্ড হতাশার সম্মুখীন হতে হয়, তা ছাড়া বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার ফলে সময়ের আগে রজোনিবৃত্তি (মেনোপজ) হয় এবং ডিম্বাশয়ে নাকি নিশ্চিত ক্যানসারের সম্ভাবনা। এমন প্রচারে মানুষ স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করা খুব জরুরি।

গৌতম খাস্তগীর

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০০:০৬

সন্তানহীন মহিলাদের কৃত্রিম গর্ভস্থাপনের বিরুদ্ধে কোনও কোনও মহল থেকে একটা প্রচার চলছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অন্তহীন সময় লাগে, বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়, প্রচণ্ড হতাশার সম্মুখীন হতে হয়, তা ছাড়া বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার ফলে সময়ের আগে রজোনিবৃত্তি (মেনোপজ) হয় এবং ডিম্বাশয়ে নাকি নিশ্চিত ক্যানসারের সম্ভাবনা। এমন প্রচারে মানুষ স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করা খুব জরুরি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এখন ব্যক্তিগত মতামতের আদৌ কোনও গুরুত্ব নেই। যত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তার সম্মিলিত পর্যালোচনার (মেটা-অ্যানালিসিস) ফলই আমাদের যথাযথ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে।

আমরা জানি, সব সুস্থ দম্পতি প্রতি মাসেই গর্ভসঞ্চারের ক্ষেত্রে সাফল্য পান না। প্রতি মাসে স্বাভাবিক গর্ভধারণের ক্ষমতা গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এখন ৩৫-এর নীচে মহিলাদের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য (প্রসবের হার) প্রতি বারে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ছ’বার চিকিৎসা করালে সাফল্য আসে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। পরিসংখ্যানের জন্য দেখতে দ্রষ্টব্য: www.hfea.co.uk এবং en.wikipedia.org.wiki\in_vitro_fertilisation.

তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এমন কোনও গবেষণাপত্র পেলাম না যেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার সঙ্গে সময়ের আগে মেনোপজের সরাসরি যোগ আছে। দ্রষ্টব্য: দেখে নিন en.wikipedia.org.wiki/premature_ovarian_failure. প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি ডিম্বাণু এমনিতেই নষ্ট হয়। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় এই ডিম্বাণুগুলিকে বড় করে বের করে আনা হয়। তাই ডিম্বাশয়ে জমা মোট ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে প্রি-ম্যাচিয়োর মেনোপজের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

ডিম্বাণু নিঃসরণের জন্য প্রযুক্ত ওষুধে জরায়ু, ডিম্বাশয় বা স্তন ক্যানসার হতে পারে, এমনটা বলা হয়েছে গোটা পঁচিশেক প্রাসঙ্গিক সমীক্ষার মধ্যে মাত্র দুটিতে। বাকি সব সমীক্ষায় বরং এ ধারণার বিরোধিতাই করা হয়েছে। ২৫ বছরের পুরনো প্রথম গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ক্লোমিফেন সাইট্রেট ওষুধটি খুব বেশি মাত্রায় দীর্ঘদিন নিলে ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। তবে বহু আগেই বন্ধ্যাত্বের বিশ্বজনীন সব বিশেষজ্ঞ সংস্থার নির্দেশনামা অনুযায়ী কোনও সুপ্রজনন বিশেষজ্ঞই এ ওষুধ মাত্র ছ’মাসের বেশি ব্যবহার করেন না। ফলে ইনফার্টিলিটির চিকিৎসায় ক্যানসারের সম্ভাবনা অমূলক। দ্বিতীয় যে গবেষণাপত্রটি মাত্র ৩ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে, আই ভি এফ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করিয়ে ডিম্বাশয়ে টিউমারের (যা ক্যানসার নয়) সম্ভাবনা বাড়ে। লক্ষণীয়, এ ক্ষেত্রে সমীক্ষক দল গবেষণায় অপেক্ষাকৃত ছোট নমুনার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন। বাকি ২৩টি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা তথা আই ভি এফ পদ্ধতিতে জরায়ু, ডিম্বাশয় ও স্তনের ক্যানসার বাড়ে না। ককরেন ডেটাবেস রিভিউ (১৯৯০ থেকে ২০১৩) কিংবা বিবিধ মেটা-অ্যানালিসিস একই কথা বলছে। আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা রয়টার্স গত কয়েক বছরে ফার্টিলিটি ড্রাগস এবং তা থেকে উদ্ভূত জনস্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে অন্তত চারটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতেও কোথাও বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা করার ফলে ওভারিয়ন ক্যানসার হচ্ছে, এমনটা বলা হয়নি। বরং এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হচ্ছে, গোটা বিশ্বে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা করাচ্ছেন এমন মহিলারা আশ্বস্ত থাকতে পারেন। কারণ গবেষণা জানাচ্ছে যে, ওষুধ বা ইঞ্জেকশন প্রয়োগের ফলে স্তন বা অন্যান্য স্ত্রী-জননাঙ্গে ক্যানসার বাড়তে পারে, এমন কোনও নজির এখনও পাওয়া যায়নি।

বেশির ভাগ রোগ উৎপত্তির একাধিক কারণ থাকে। ডাক্তারিতে শেখানো হয় একচক্ষু হরিণ না হতে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের জানা উচিত ওভারিয়ন ক্যানসারের অনেকগুলি কারণ রয়েছে। সন্তান না হওয়া বা বন্ধ্যাত্বই এর মধ্যে একটি। ইনফার্টিলিটির সমস্যা (কিন্তু তার চিকিৎসা নয়) ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের সম্ভাবনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও কয়েকটি কারণ: পরিবারের ক্যানসারের ইতিহাস, জিনগত চরিত্রবদল (জেনেটিক মিউটেশন), এন্ডোমেট্রিয়োসিস, ওভারিয়ন সিস্ট, ডিসফাংশনাল ওভারি। এবং, ব্যাখ্যার অতীত বন্ধ্যাত্ব— শত অনুসন্ধানেও যখন প্রকৃত কারণ খুঁজে পাই না। এই আনএক্সপ্লেনড ইনফার্টিলিটি ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ায়।

তবে কয়েকটি ব্যাপার যে ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের সম্ভাবনা কমায়, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। প্রেগন্যান্সি, স্তন্যদান, এমনকী ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল (ওসিপি) ব্যবহার ডিম্বাণু নিঃসরণ বন্ধ করে ক্যানসার কমায়। তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় মহিলাদের। যাঁরা সন্তান চাইছেন, চেষ্টা করছেন অথচ হচ্ছে না, তাঁদের ক্যানসারে ভোগার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পরের গ্রুপে সেই মেয়েরা, যাঁরা স্বেচ্ছায় সন্তান চান না। এঁদের ক্যানসারের চান্স মাঝামাঝি। তৃতীয় গ্রুপে থাকা মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া মহিলারাই সবচেয়ে নিরাপদ। প্রসঙ্গত, বন্ধ্যাত্ব যেমন ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ায়, আবার সেই মহিলাদেরই চিকিৎসা করিয়ে গর্ভস্থাপন হলে আর ততটা ঝুঁকি থাকে না। পথ আরও আছে। শুনলে একটু অবাক লাগতে পারে, বন্ধ্যা মহিলারা যখন আর বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করাচ্ছেন না, তখন ওভারিয়ন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে তাঁদের ওসিপি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এক জন সুপ্রজনন বিশেষজ্ঞের কাজ মায়ের শূন্য কোল ভরানো। তা করতে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে অহেতুক তাঁর রোগী ক্যানসারের মতো কোনও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হোন। ১৯৭৮ থেকে ২০০৩, প্রথম ২৫ বছরে কৃত্রিম প্রজননে দশ লাখ আই ভি এফ শিশু জন্মায়। ২০০৫, অর্থাৎ ঠিক দু’বছরের মধ্যেই সংখ্যাটা পৌঁছয় কুড়ি লাখে। ২০১৩ সালে গোটা পৃথিবীতে আই ভি এফ শিশুর সংখ্যা পঞ্চাশ লাখ। কৃত্রিম প্রজনন ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলে সংখ্যাটা এমন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত কি?

এ নিবন্ধের প্রতিটি তথ্য এবং প্রায় ত্রিশ বছরব্যাপী বিজ্ঞানসম্মত যাবতীয় গবেষণা আন্তর্জালের এক ক্লিকেই আপনার নাগালে পৌঁছবে। দেখে নিন www.cancer.org, www.cancerresearchuk.org, www.cancer.gov কিংবা www.ovariancancer.org ওয়েবসাইটগুলি। চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিক্ষিপ্ত দু’একটি গবেষণাকে ভিত্তি না করে প্রকাশিত সমস্ত গবেষণার মেটা-অ্যানালিসিসকে গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়।

চিকিৎসক, সুপ্রজনন বিশেষজ্ঞ

gautam khastagir
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy