বাঙালি হইলেই ব্রাজিলের সমর্থক হইতে হইবে, নিয়ম। ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় নিজ দেশের হইয়া গলা ফাটাইবার রেওয়াজ প্রায় বাধ্যতামূলক হইলেও, অন্য দেশের হইয়া আহার-নিদ্রা ভুলিয়া উল্লম্ফন অতীব বিস্ময়কর। পশ্চিমবঙ্গের দেওয়ালে ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়দিগের অতিকায় চিত্র, ক্লাবে তাঁহাদের পোস্টার, পথে তাঁহাদের পতাকা— দুর্গোৎসবের মতোই ঐতিহ্যের অঙ্গ। মারাদোনার উত্থানের পর আর্জেন্টিনার ভাগেও ভক্তকুলের লুটাপুটি, ফলে দেওয়ালচিত্রে আসিয়াছে বৈচিত্র, পাড়ায় পাড়ায় ছুটিয়াছে ইস্ট বনাম মোহন মার্কা বিরোধিতার মশল্লাঘ্রাণ। বহু মানুষ ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলা থাকিলে নিজ গৃহে বান্ধবদলকে আমন্ত্রণ জানাইয়া টিভির সম্মুখে বসিতেছেন এবং ‘ওরে, বাঁ দিকে যা’, ‘ব্যাকভলি কর রে বুদ্ধু’, ‘মেসি, শট, জোরে’ চিৎকার করিয়া প্রিয় খেলোয়াড়দিগকে আশু কর্তব্য সম্বন্ধে অবগত করিতেছেন। কার্যব্যপদেশে কাহাকেও বাথরুমগমন করিতে হইলে, ক্ষুদ্র অনুচর নিয়োগ করিতেছেন, যে কিনা ‘বাবা, নেইমার পাস দিতে পারেনি’ বা ‘ওগো বেরোও, গোওওল’ বলিয়া ধারাবিবরণী সরবরাহ করিবে। প্রিয় দল হারিয়া গেলে অনেকে বদন গ্রাম্ভারি করিয়া অফিস যাইতেছেন ও বাড়িতে প্রভূত অশান্তি করিয়া নিজ নৈরাশ্য বিজ্ঞাপিত করিতেছেন। কেহ আর্জেন্টিনার জার্সি পরিয়া শুইতে যাইতেছেন। কেহ রাগিয়া পোষ্য মার্জারের নাম বিপক্ষীয় স্ট্রাইকারের নামে রাখিতেছেন। উন্মাদনায় ও আন্তরিক আনুগত্যে এই রাজ্য যে ব্রাজিলের বা আর্জেন্টিনার তুলনায় কোনও অংশে ন্যূন নহে, তাহা দামামা বাজাইয়া প্রমাণ করিবার এমন আপ্রাণ প্রয়াস দেখিয়া কখনও কখনও ইহার সারবত্তা সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। উত্তাপ হইতে বহু মাইল দূরে থাকিয়া অকস্মাৎ এমন উথলাইয়া পড়া ফ্যানের কারণ কী, তাহা লইয়া সেমিনার গড়িতে ইচ্ছা যায়।
এই দেশগুলি সম্পর্কে বাঙালির রটনা: ইহারা কারুকার্য-নির্ভর ফুটবল খেলিয়া থাকে, পেশিশক্তির উপর নির্ভর করে না। আর ইউরোপীয় দেশগুলি নাকি দৈহিক শক্তির উপর অধিক নির্ভরশীল। বাহুবলকে আন্তরিক ঘৃণা করিতে অভ্যস্ত বাঙালি (তাহার শীর্ণতা তাহার চেতনাকে গড়িয়াছে) স্বভাবতই এই সূক্ষ্ম শিল্পঘরানাকে ভালবাসিতে উদ্গ্রীব। তাহার উপরে, এক সময়ে পেলে ছিলেন প্রায় তর্কাতীত ভাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। তাঁহার খ্যাতিও ব্রাজিলকে প্রাণপ্রিয় করিতে সাহায্য করিয়াছে। মারাদোনা তাঁহার ভেল্কি দেখাইয়াছিলেন, টেলিভিশনের দৌলতে, সর্বসমক্ষে। ফলে তাঁহার দেশের দিকে ঝুঁকিতে তৎকালীন তরুণতরুণীদের অসুবিধা হয় নাই। ইহাও মনে রাখিতে হইবে, এইগুলি লাতিন আমেরিকান দেশ, ফলে দারিদ্রে ও বঞ্চনায় ইহারা বাঙালির সমীপবর্তী। ইহাদের দেখিলে বিদেশি মনে হয়, কিন্তু সাহেব মনে হয় না। ইহাদের বহু কিংবদন্তি খেলোয়াড় ঝুপড়ি বা বস্তি হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন, শৈশবে তাঁহারা ন্যাকড়া পাকাইয়া ফুটবল খেলিতেন, প্রকৃত বল কিনিবার পয়সা ছিল না। তাই ইহারা যখন সাদা মানুষদের মস্তক ধূলায় মিশাইয়া দেয়, তখন বাঙালির শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী সত্তা প্রবল আরাম লাভ করে, তাহার স্ট্রাগ্ল-লেহী আত্মা সার্থকতার নৃত্যটি ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিয়া লয়। তবে, হয়তো এত দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ সিদ্ধান্তের অর্থ নাই, বাঙালি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা লইয়া এমন নাচানাচি করিতেছে, স্রেফ প্যাশনটি বাপ-দাদাদের মধ্যে প্রবাহিত দেখিয়াছে বলিয়াই। এমনিতেই বাঙালির সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ কাজ নাই। সিরিয়াল বা আইপিএল বা নির্বাচন তাহাকে অবসাদ হইতে বাঁচাইয়া রাখে। চার বৎসর অন্তর বিশ্বকাপ আসিলে সে পুনরায় হুজুগ আঁকড়াইয়া উত্তেজনা-সংগ্রহে নামিয়া পড়ে। বিভিন্ন দেশের খেলার বিচার না করিয়া, এমনকী ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলাও বিশেষ না দেখিয়া, তাহাদের প্রায় কোনও খেলোয়াড়ের নাম না জানিয়া, তাহারা সোল্লাসে সমবেত চিৎকার শুরু করে। কারণ চেঁচাইতে বড় সুখ। জানিতে নহে, প্রথা মানিতে বড় আনন্দ।
য ৎ কি ঞ্চি ৎ
বাড়ির রং নীল-সাদা করলে কর মকুব। হয়তো এক সময় ফরমান জারি হবে, নীল-সাদা স্ট্রাইপ শার্ট পরে অফিস গেলে বেশি সিএল, নিদেন টিফিনে এক্সট্রা লেড়ো বিস্কুট। বাচ্চার নাম শুভ্রনীল রাখলে তার অঙ্ক পরীক্ষায় ছত্রিশ নম্বর গ্রেস। আর্জেন্টিনার দূরদৃষ্টি দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। কবে থেকে জার্সি এই রঙে ছুপিয়ে রেখেছে! কলকাতায় মেসি খেলতে এলে তাঁর বাসভাড়া তক্ষুনি মকুব। তবে মাঠে নেমে ধন্দে: রেফারির পকেট থেকে লাল-হলুদের বদলে নীল ও সাদা কার্ড উঁকি মারছে!