একালে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা মূলত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এবং বিশ্ব আর্থনীতিক সম্মিলনের সহিত বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজনের সাদৃশ্য প্রবল, প্রমাণ করিতেছে ব্রাজিল। ইতিপূর্বে বিভিন্ন বিশ্ব বাণিজ্য বৈঠকের সামনে প্রতিবাদের উত্তাল ঢেউ আছড়াইয়া পড়িবার যে ছবি বার বার দেখা গিয়াছে, একই ছবি দেখা গেল ব্রাজিলে বিশ্বকাপের প্রেক্ষিতে। তবে বৃহত্তর বিশ্ব অর্থনীতি নয়, দেশের নিজস্ব অর্থনীতির সংকট হইতেই এই প্রতিবাদের জন্ম। এক দিকে বিশ্বকাপ আয়োজনকে কেন্দ্র করিয়া সরকারের বিপুল অর্থব্যয়, অন্য দিকে দেশের অর্থনীতির মন্দা ও তজ্জনিত সংস্কারের চাপ, জনসমাজের একাংশকে খেপাইয়া দিয়াছে। তাই বৃহস্পতিবার, প্রতিযোগিতা সূচনার দিনে সাও পাওলোর রাস্তায় যেমন উল্লাসের বহর পুরাতন রেকর্ড ভাঙিয়া দিল, তেমনই দেখা গেল পুলিশের সহিত প্রতিবাদীদের খণ্ডযুদ্ধ, লাঠিচার্জ, অগ্নিসংযোগ, রাবার বুলেটের প্রতাপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ হইলেও প্ল্যাকার্ড ফেস্টুনে ফিফা ও ব্রাজিল সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান ছড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ ইতস্তত পাথর নিক্ষেপ, জঞ্জালের স্তূপে আগুন ধরাইয়া অশান্তি বাড়াইবার প্রয়াস, এবং পুলিশ-প্রশাসনের ত্বরিত তীব্র দমননীতির প্রকাশও দেখা গেল রিও ডি জেনেইরো, সাও পাওলো, ব্রাসিলিয়া-সহ প্রায় প্রতিটি বড় শহরে।
যেখানে দেশের অর্থনীতির এই হাল, কেন সরকার এই বিপুল ব্যয়যজ্ঞে আত্মনিয়োগ করিবে, ইহাই প্রতিবাদীদের প্রশ্ন। বিশ্বকাপ আয়োজনে ২০০৬ সালে জার্মানি যত খরচ করিয়াছিল, তাহার প্রায় দ্বিগুণ খরচ করিয়াছে মন্দাক্রান্ত উন্নয়নশীল দেশ ব্রাজিল। আন্দোলনের একটি প্রত্যক্ষ লক্ষ্যও মিলিয়াছে। এই রাজসূয় ব্যয়যজ্ঞ চলিতে চলিতেই ব্রাজিল সরকার পরিবহণ খরচ বাড়াইয়া দিয়াছে প্রায় দশ শতাংশ। সাধারণ মানুষের নিত্য চলাচলের পথে এই নূতন কাঁটা ক্ষোভের আগুন বাড়াইতে দেরি করে নাই। ইহা ছাড়াও আছে ব্যাপক দুর্নীতি, পুলিশি অত্যাচার, মন্দার প্রকোপে গৃহহীনতার দ্রুত বৃদ্ধি। এক রিও ডি জেনেইরো শহর হইতে কেবল সরকারি প্রয়াসে গত বৎসরে কুড়ি হাজার গৃহহীনকে কোনও মতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইয়াছে। লক্ষণীয়, অসাম্য যেখানে প্রবল ভাবে দৃশ্যগোচর, সেখানেই অশান্তি ও প্রতিবাদের ঢল। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটিতেছে শহরগুলিতে, নাগরিক সমাজের নীচের দিকেই বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত বলিয়া।
প্রতিবাদের বক্তব্য সরল হইলেও মূল প্রশ্নটি জটিল, সন্দেহ নাই। ব্রাজিল একটি পুরাতন প্রশ্ন আবার নূতন করিয়া তুলিয়া দিল। এই ধরনের বড় আন্তর্জাতিক আয়োজন কি তাহা হইলে কেবল উন্নত ও সম্পন্ন দেশগুলিরই কুক্ষিতে থাকা বিধেয়? আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়া-প্রতিযোগিতার মান যেখানে উঠিয়া গিয়াছে, তাহাতে এমন কোনও আয়োজনে যে ‘ফেস-লিফ্ট’ বা মুখরক্ষা ব্যয় আবশ্যিক, তাহা বুঝিতে অসুবিধা নাই। ব্রাজিল বাড়াবাড়ি করে নাই, আয়োজক দেশ হিসাবে মনোনীত হইবার পর ইহাই তাহার নিকট প্রত্যাশিত। সে ক্ষেত্রে কি আয়োজনের দায়িত্ব বণ্টনের বিষয়টিরই পুনর্ভাবনা জরুরি? কিন্তু উন্নত দেশগুলির উপরই এই দায়িত্ব চিরকাল রাখিয়া গেলে কি সেখানেও এক ধরনের অসাম্যের ভিত তৈরি হয় না? ব্রাজিলে বিশ্বকাপ কি এক ভিন্ন অর্থে ব্রাজিলকেই বিশ্বপটে নূতন পরিচয় দেয় না? সে পরিচয় কতটা সামাজিক অর্জন, আর কতটা রাষ্ট্রিক, সে প্রশ্ন থাকিয়াই যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ব্যয়সাধ্য বলিয়া তাহা আয়োজন করা চলিবে না, এই দাবি মানিয়া লওয়া কঠিন।