Advertisement
E-Paper

বন্দুক বনাম

ছিল বন্দুক বনাম মাখন। হইল বন্দুক বনাম বই। এখন হইতে ভুবন-অর্থনীতির কাণ্ডারিরা সূত্রটি বেবাক পাল্টাইয়া ফেলিতে পারেন। এত দিন তাঁহারা বলিতেন, সম্পদ সীমিত, সেই সীমিত সম্পদ দিয়া বন্দুক নির্মাণ করা হইবে না মাখন উত্‌পাদন, তাহাই আদি প্রশ্ন। মালালা ইউসুফজাই নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণের বক্তৃতায় জানাইয়া দিলেন, বাছিয়া লইতে হইবে: বন্দুক না বই।

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

ছিল বন্দুক বনাম মাখন। হইল বন্দুক বনাম বই। এখন হইতে ভুবন-অর্থনীতির কাণ্ডারিরা সূত্রটি বেবাক পাল্টাইয়া ফেলিতে পারেন। এত দিন তাঁহারা বলিতেন, সম্পদ সীমিত, সেই সীমিত সম্পদ দিয়া বন্দুক নির্মাণ করা হইবে না মাখন উত্‌পাদন, তাহাই আদি প্রশ্ন। মালালা ইউসুফজাই নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণের বক্তৃতায় জানাইয়া দিলেন, বাছিয়া লইতে হইবে: বন্দুক না বই। দেশে দেশে কোনটি রফতানি হইবে, রাষ্ট্রপুঞ্জকে তাহা নির্বাচন করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, একটি পাঠাইলে অন্যটির ভাগ যে কেবল কম পড়িবে তাহা নহে, একটি কিনিলে অন্যটির উপযোগিতাও দ্রুত কমিতে থাকিবে। মালালা ইউসুফজাই তাঁহার সাম্প্রতিক বক্তৃতায় এই নূতন মডেলটির আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহার শান্ত, দৃঢ় কণ্ঠে বই বনাম বন্দুকের বার্তা ধ্বনিত হইয়াছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সেই বার্তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারিবে, এমন ভরসা কম, তবে নোবেল শান্তি-পুরস্কার বিজয়িনী কিশোরীর এই আন্তরিক আবেদন ঐতিহাসিক হইয়া থাকিবে বই কী।

মালালা নিজে বই ও বন্দুক, দুটিকেই খুব কাছ হইতে দেখিয়াছেন। বইয়ের প্রতি বিশ্বস্ততার জন্যই বন্দুক তাঁহাকে মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত লইয়া গিয়াছিল। মৃত্যুর সেই নৈকট্য তাঁহাকে জানাইয়া দিয়াছে, পৃথিবী হইতে হয়তো বন্দুক মুছিয়া ফেলিবার সাধ্য এই মূহূর্তে কাহারও নাই। কিন্তু অন্য একটি পথ আছে: তাহা বন্দুক-চর্চিত হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই জারি করা— বন্দুক দিয়া নহে, বই দিয়া। বের্টোল্ট ব্রেখ্‌ট-এর সেই বিখ্যাত কথাটিই মালালার বক্তব্যের সার: বই-ই বুভুক্ষু মানুষের অস্ত্র। নিপীড়িতেরও। বই রক্তের ধারা বহায় না, বরং রক্তবীজ ছড়াইয়া দিয়া যুদ্ধ করে, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহস ও শক্তি প্রসার করে। পাকিস্তান কিংবা ভারতের ক্ষীণপ্রাণ অর্থনীতিও প্রতিরক্ষার নামে বিপুল অস্ত্রসম্ভারের ব্যয় আটকাইতে পারে না, অথচ সেই ব্যয়ের সামান্য কয়েক শতাংশ বইয়ের দিকে ঘুরাইয়া দিলেই দেশগুলির সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং সর্বোপরি, মানবিক চালচিত্র আমূল বদলাইয়া যায়। চোখের বদলা চোখ, অস্ত্রের বদলা অস্ত্র তো একবিংশ সভ্যতাকে আত্মধ্বংসের কিনারায় আনিয়া ফেলিয়াছে। এ বার খেলাটি ঘুরাইয়া দিলে মন্দ কী! আধুনিক বিশ্বের সন্ত্রাস-উন্মত্ততার প্রেক্ষিতে মালালার এই আবেদন কেবল ঐতিহাসিক নয়, প্রতীকী মর্যাদায় উত্তীর্ণ।

মালালা ইউসুফজাই ইতিমধ্যেই পশ্চিমি দুনিয়ার তৈরি করা প্রতীক, সন্ত্রাস-যুদ্ধের অন্যতম ‘অস্ত্র’। কুড়ি-অনুত্তীর্ণা কন্যা নিজের স্বাভাবিক জীবন হইতে ছিন্ন হইয়া সগৌরবে তাঁহার প্রতীকী জীবনে প্রবেশ করিয়াছেন। মালালা কেন এই ভাবে প্রতীকে পর্যবসিত হইলেন, এই চর্বিত প্রশ্ন চর্বণে লাভ নাই। বরং যে বিশ্ব-রাজনীতিপট মালালার মতো প্রতীকের প্রয়োজন দুর্নিবার করিয়া তোলে, এবং শেষ পর্যন্ত তাহা তৈয়ারি করিয়া ছাড়ে, সেই বিষয়েই ভাবনার গতি চালনা করা দরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতি ধ্বনিত হইলেও ইহা কোনও বিশেষ সংগঠন বা কোনও বিশেষ রাষ্ট্রের প্রতি নয়, ইহা আসলে গোটা বিশ্ব-ব্যবস্থার জন্যই প্রযোজ্য। তবে ব্যবস্থা তো কোনও বিমূর্ত বস্তু নয়। নানা মূর্ত রাষ্ট্র ও সংগঠনের সমবায়েই সেই ব্যবস্থার উত্‌পত্তি। সংঘাত এবং অস্ত্র ক্ষমতার দ্বারাই সৃষ্ট ও লালিত। সুতরাং মালালার প্রস্তাব কার্যকর করিতে হইলে ক্ষমতার গলায় ঘণ্টা বাঁধিতে হইবে। সেই ক্ষমতা কাহার আছে, তাহাই শেষ প্রশ্ন।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy