আবদুর রেজ্জাক মোল্লার পর লক্ষ্মণ শেঠ। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি হইতে অল্প দিনের ব্যবধানে দুই প্রভাবশালী নেতাকে ‘বহিষ্কার’ করা হইল। বহিষ্কারের ঘোষণার সময় দলীয় গঠনতন্ত্রের কথা শোনানো হইয়াছে। সেই তন্ত্রের কত নম্বর ধারায় এবং কত নম্বর উপধারায় এই সিদ্ধান্ত, ইহাকে ‘তাৎক্ষণিক বহিষ্কার’ বলা হইবে, না কি অন্য কোনও পরিভাষা ব্যবহৃত হইবে, তাহা দলের নিজস্ব মাথাব্যথার কারণ হইতে পারে। জনগণ কেবল দেখিলেন, একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুই নেতা সিপিআইএমে থাকিতে পারিলেন না। এতটাই প্রতাপ ছিল লক্ষ্মণ শেঠের যে, তাঁহাকে ‘হলদিয়ার মুকুটহীন সম্রাট’ নামে ডাকা হইত। তিনি কিংবা রেজ্জাক মোল্লা কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরিয়াই তথাকথিত ‘দলবিরোধী ক্রিয়াকলাপ’ করিয়া যাইতেছিলেন। দলীয় নেতৃত্ব এবং নীতি-কর্মসূচি সম্পর্কে এমন আপত্তিকর সব কথা তাঁহারা বলিতেছিলেন যাহাতে মনে হয়, তাঁহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে দলকে একপ্রকার বাধ্যই করিতেছিলেন। লক্ষ্মণ শেঠ তো দলীয় সদস্যপদ নবীকরণ পর্যন্ত করান নাই। শেষ পর্যন্ত যখন তাঁহাদের ‘বহিষ্কার’ করা হইল, তাহার অনেক আগে হইতেই কার্যত তাঁহারা নিজেদের বহিষ্কৃত করিয়াছেন।
এহ বাহ্য। দীর্ঘ অপশাসনের কালে সিপিআইএম নেতৃত্ব লক্ষ্মণ শেঠ বা তাঁহার সহগামীদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে সর্বতো ভাবে ব্যবহার করিয়াছিলেন। নন্দীগ্রাম কাহিনির সূচনাপর্বে আত্মঘাতী অভিযান এবং পরবর্তী অধ্যায়ে গ্রাম পুনর্দখলের ‘সূর্যোদয়’ সম্ভব করাইতে এই ‘সম্পদ’দের পুরস্কৃত করা হয়, জিন্দাবাদ দেওয়া হয়, এমনকী মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ‘উহাদের’ সমুচিত প্রতিদানের সাফল্যে গর্ব প্রকাশ করেন। রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ওই সব অপকাণ্ডের তদন্ত শুরু হওয়ায় এই সম্পদরা বিপদে পড়িয়া যান এবং তাঁহাদের জেল-হাজতও হইতে থাকে। সেই পর্বেও ধৃত সম্পদদের জামিনে মুক্তির সময় তাঁহাদের লাল আবিরে রাঙানো হইয়াছে, জয়ধ্বনিও দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এখন দলের প্রকৃত দুঃসময়। লক্ষ্মণ শেঠ এখন দলের বোঝা। তদুপরি তিনি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি কামান দাগিতে থাকেন। তাঁহাকে বহিষ্কার না করিয়া দলের উপায় ছিল না।
স্বভাবতই, এই বহিষ্কার দলকে কোনও বাড়তি মহিমা প্রদান করিবে না। অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের বিতাড়িত করিয়া দলকে পরিশুদ্ধ করা হইতেছে, এই ভান করারও সুযোগ নাই। কেননা কোনও শুদ্ধকরণ আন্দোলনের মধ্য দিয়া এই বেনো জল বহিষ্কার হইতেছে না। সিপিআইএম নেতৃত্ব যে এখনও তেমন কোনও সৎ এবং কার্যকর শুদ্ধকরণের কথা ভাবিতেছেন, তাহারও বিশেষ লক্ষণ নাই। বেনো জলেরা অনেকে হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক নিয়মে আপনাআপনি বাহির হইয়া গিয়াছে, ঠিক যে ভাবে তাহারা এক কালে ক্ষমতা ও তজ্জনিত প্রাপ্তিযোগের আকর্ষণে ভিতরে আসিয়াছিল। কিন্তু তাহাকে শুদ্ধিকরণ বলিলে স্তালিনও লজ্জিত হইবেন। আরও বড় কথা, দলীয় নেতৃত্বের উচ্চ স্তরে যে শুদ্ধির প্রয়োজন, তাহার কোনও সংকেতও তো এখনও মিলিল না। ভরাডুবির প্রায় তিন বছর পরেও সিপিআইএম বলিতে সেই একই মুখের সারি, একই কণ্ঠে একই কথা এবং একই সুর। লতা মঙ্গেশকরের পরে এমন দীর্ঘমেয়াদি একাধিপত্য সহকারে আর কেহ বোধহয় গাহিতে পারেন নাই, যতটা সিপিআইএমের বঙ্গীয় নেতারা গাহিয়াছেন এবং গাহিতেছেন। লক্ষ্মণ শেঠের বিদায় সেই গড্ডলিকায় কতটুকু তফাত ঘটাইবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy