জিডিপি, অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অবশ্যই অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। কিন্তু, যাহা গুরুত্বপূর্ণ, সর্বদা তাহাই আলোচনার কেন্দ্রে থাকিলে অনেক সুবর্ণসুযোগ চোখ এড়াইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা। এখনই যেমন। এই বৎসর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে জিডিপি-র বৃদ্ধি-হার গত ত্রৈমাসিকের ৫.৭ শতাংশ হইতে কমিয়া ৫.৩ শতাংশে দাঁড়াইল, এই সংবাদটি যদি প্রচারের সব আলো কাড়িয়া লয়, তবে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম তলানিতে আসিয়া ঠেকিবার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আত্মস্থ করা মুশকিল হইতে পারে। জিডিপি খানিক বাড়ুক বা কমুক, মারাত্মক কিছু না ঘটিলে বৎসরের শেষে তাহা সাড়ে পাঁচ শতাংশের কাছাকাছিই থাকিবে বলিয়া অনুমান করা চলে। ভারতীয় অর্থনীতি তলানি হইতে ফিরিতেছে। প্রত্যাবর্তনের পথটি অন্তত কিছুটা প্রত্যাশিত। কিন্তু, তেলের দাম সচরাচর এই ভাবে ধরাশায়ী হয় না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার কী ভাবে করা যায়, আপাতত তাহাই প্রধান বিবেচ্য। সুযোগটি লইতে পারিলে অর্থনীতির লাভ।
অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানির বিচারে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। কয়লার ক্ষেত্রে তৃতীয়, প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে পঞ্চম। সব মিলাইয়া, জ্বালানি আমদানিতে ভারতের স্থান গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত চতুর্থ। জ্বালানি আমদানি করিতেই জিডিপি-র ছয় শতাংশের বেশি টাকা খরচ হয়। খরচের সিংহভাগ যায় পেট্রোলিয়াম কিনিতে। অতএব, গত ছয় মাসে পেট্রোলিয়ামের দাম ৪০ শতাংশ কমায় আমদানি ব্যয় বহুলাংশে কমিয়াছে। তেলের দাম আরও কমিলে বছরের শেষে দেখা যাইতে পারে, আমদানি করিতে ভারতের মোট যত ব্যয় হইয়াছে, রফতানি হইতে আয় হইয়াছে তাহার বেশি। গত এক দশকে এমন বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হয় নাই। ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ আসিবার বর্তমান হারটি যদি বজায় থাকে, তবে দেশের বাজারে ডলারের বন্যা বহিবে। টাকার দাম বাড়িবে। কেরোসিন আর এলপিজি ভিন্ন পেট্রোলিয়াম ভর্তুকির প্রয়োজন হইবে না, ফলে রাজকোষ ঘাটতিও কমিবে। পেট্রোলিয়াম বিপণনকারী সংস্থাগুলির লাভের খাতা ফুলিয়া উঠিবে, মূল্যস্ফীতি কমিবে। ‘আচ্ছে দিন’।
হাত-পা গুটাইয়া থাকিলেই যদি এত লাভ হয়, তবে আর নড়িয়া বসিবার প্রয়োজন কী? দুইটি। এক, ভাগ্যদেবতার এই স্মিতহাস্যটির লাভ ষোলো আনা উসুল করিতে হইলে চেষ্টার বিকল্প নাই। দুই, এই লাভের চোটে টাকার দাম বাড়িয়া গেলে রফতানির বাজারে মুশকিল, প্রধানমন্ত্রীর ‘ভারতে নির্মাণ’ কর্মসূচিতেও ধাক্কা লাগিবে। অতএব, সরকারের উদ্যোগ জরুরি। প্রথম কাজ, পেট্রোলিয়ামের উপর কেন্দ্রীয় করের প্রত্যাবর্তন। গত দশকে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম চতুর্গুণ হওয়ায় কেন্দ্র কার্যত বাধ্য হইয়া প্রায় সব কর উঠাইয়া লয়। রাজ্য সরকারগুলি কর আদায় করে বটে, অর্থনীতির পক্ষে তাহা যথেষ্ট নহে। এখন তেলের দাম অস্বাভাবিক কম, অল্প আমদানি শুল্ক বসাইলে ক্রেতার গায়ে লাগিবে না, কিন্তু রাজকোষে বাড়তি ৬০,০০০ কোটি টাকা ঢুকিবে। সেই টাকায় কেরোসিন-এলপিজির ভর্তুকি দিয়াও সম্ভবত উদ্বৃত্ত থাকিবে। কম ভর্তুকি ও বাড়তি কর আদায়, দুইয়ে মিলিয়া রাজকোষ ঘাটতি অনেক কমাইতে পারে। কম দামে মধ্যবিত্তকে তেল বেচিবার সস্তা জনপ্রিয়তার কথা না ভাবিয়া অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করাই কর্তব্য।