প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি সংসদে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন, নূতন সেনাধ্যক্ষ পদে লেফটেনান্ট জেনারেল দলবীর সিংহ সুহাগের নিয়োগ চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয়। তাঁহাকে ওই পদে নিয়োগ করে পূর্বতন মনমোহন সিংহ সরকার, তাহার বিদায়বেলায়। একটি বিদায়ী সরকারের পক্ষে দেশের সেনাধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নৈতিক ভাবে বৈধ কি না, বিশেষত যখন পদটি খালি হইতে পর্যাপ্ত সময় বাকি ছিল, সেই বিষয়ে তখনই বিজেপি প্রশ্ন তুলিয়াছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর সরকার পূর্বসূরির ওই নিয়োগ বহাল রাখারই সিদ্ধান্ত লয়। পূর্বতন সরকারের নিয়োগ বলিয়াই বর্তমান সরকারকে তাহা নাকচ করিতে হইবে, এই রাজনৈতিক সংকীর্ণতা হইতে মুক্ত সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। যে তৎপরতার সহিত এই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হইয়াছে, তাহাও আশাব্যঞ্জক।
তৎপরতার বিশেষ কারণও আছে। সেই কারণটির নাম: ভি কে সিংহ। ভূতপূর্ব সেনাধ্যক্ষ, এখন বিজেপি সাংসদ ও মন্ত্রী সিংহ মহাশয় সমগ্র বিষয়টিতে জড়াইয়া আছেন এবং সেই সংস্রব তাঁহার দল, সরকার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে রীতিমত অস্বস্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তিনি ইতিপূর্বে দলবীর সিংহ সুহাগের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, ভূতপূর্ব সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সেই আপত্তির কঠোর সমালোচনা করিয়া তাহা উড়াইয়া দিয়াছিল, বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও সেই অবস্থান হইতে সরে নাই এবং ভি কে সিংহ তাঁহার আপন সরকারের এই অবস্থানকে কটাক্ষ করিয়াছেন। এক দিকে সেনাধ্যক্ষ নিয়োগের মতো গুরুতর প্রশ্ন, অন্য দিকে সেই প্রশ্নে সরকারি সিদ্ধান্তে এক জন মন্ত্রীর দ্বিমত পোষণ ও উচ্চারণ— পরিস্থিতি নবাগত সরকারের পক্ষে বিড়ম্বনার কারণ বইকী। সেনাধ্যক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকিয়া এবং বিষয়টিকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখিবার কথা দ্রুত ঘোষণা করিয়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক দিক সামাল দিয়াছেন, কিন্তু অন্য দিকটি এখনও বিপদসংকুল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে, ইহার পরেও কী ভাবে ভি কে সিংহ তাঁহার মন্ত্রিপদে বহাল থাকিতে পারেন, নরেন্দ্র মোদীই বা কী ভাবে তাঁহাকে বহাল রাখিতে পারেন? প্রশ্নটি উড়াইয়া দেওয়া কঠিন।
নরেন্দ্র মোদী হয়তো মনে মনে নিজেকেই দোষ দিতেছেন, কেন তিনি ভি কে সিংহকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়াছিলেন। প্রথমত, সেনানায়ক নিয়োগের বিষয়ে ভূতপূর্ব সেনাধ্যক্ষের ঘোষিত আপত্তি যে সমস্যার সৃষ্টি করিতে পারে, তাহা পূর্বেই অনুমান করা উচিত ছিল। কিন্তু কেবল এই কারণে নহে, ভি কে সিংহের পূর্ব-আচরণ সাধারণ ভাবেও উদ্বেগজনক ছিল— তিনি পদোন্নতির প্রশ্নে বয়সের হিসাব লইয়া যাহা করিয়াছিলেন, তাহাকে ‘বিচিত্র’ বলিলে কম বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী দাবি করিয়া থাকেন যে, তিনি মানুষ চিনিতে ভুল করেন না। তিনি অবশ্য এখন বলিতেই পারেন যে, ভুল মানুষমাত্রেরই হয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভুল কেবল ব্যক্তিগত নয়। সেনাধ্যক্ষ অবসরগ্রহণের পরেই দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিবেন, ইহা কি নীতিসম্মত? আইনের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন নৈতিকতার। ভারতীয় গণতন্ত্রে রাজনীতি হইতে সেনাবাহিনীর দূরত্ব কতখানি মূল্যবান, তাহা বিশ্ববিদিত। এই দূরত্ব যে ভাবে সসম্মান রক্ষিত হইয়াছে, তাহা বিশ্ববন্দিতও। তাহার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল থাকিবার জন্যই সেনানায়কদের অবসরজীবনেও দলীয় রাজনীতি হইতে শত যোজন দূরে থাকাই বিধেয়, অতীতে তাঁহাদের আচরণে সেই বিচক্ষণতা দেখা গিয়াছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য, সেনাবাহিনীরও দুর্ভাগ্য, ভি কে সিংহ সেই পথ অনুসরণ করেন নাই, উর্দি খুলিয়াই ভোটপ্রার্থী হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহাকে বরণ করিবার আগে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দলের ভাবা উচিত ছিল।