Advertisement
E-Paper

ভারত ও পাকিস্তান, দু’দেশের মনস্তত্ত্বেই আতঙ্ক লুকিয়ে

পাকিস্তানে নির্বাচন ‘কভার’ করতে গিয়ে এক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেলুনে চুল কাটাচ্ছি, বেঞ্চে বসে আছেন পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কর্মী। যত ক্ষণ চুল কাটালাম, তিনি বসে বসে ফিল্মি পত্রিকা পড়লেন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। তার পর আমি যেই বেরিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি, পাঠানস্যুট পরিহিত শ্মশ্রুগুম্ফধারী যুবকটি আমাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। পরে অনেক দিন থাকতে থাকতে যুবকটির সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। হোটেলের ঘরে থাকলে, বাইরে গাছতলার নীচে থাকতেন। জানলার দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেন, গাড়ির পিছনে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসতেন। পরে যুবকটি বলেছিলেন, “রমজানের উপবাস চলছে, কিন্তু কী করব? এটাই ডিউটি।”

তবু শান্তির পথকে শেষ সমাধান বলে ভাবতেই হবে! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

পাকিস্তানে নির্বাচন ‘কভার’ করতে গিয়ে এক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেলুনে চুল কাটাচ্ছি, বেঞ্চে বসে আছেন পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কর্মী। যত ক্ষণ চুল কাটালাম, তিনি বসে বসে ফিল্মি পত্রিকা পড়লেন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। তার পর আমি যেই বেরিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি, পাঠানস্যুট পরিহিত শ্মশ্রুগুম্ফধারী যুবকটি আমাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। পরে অনেক দিন থাকতে থাকতে যুবকটির সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। হোটেলের ঘরে থাকলে, বাইরে গাছতলার নীচে থাকতেন। জানলার দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেন, গাড়ির পিছনে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসতেন। পরে যুবকটি বলেছিলেন, “রমজানের উপবাস চলছে, কিন্তু কী করব? এটাই ডিউটি।”

আসলে, ভারতীয় সাংবাদিকদের সাধারণ ভাবে পাক কর্তৃপক্ষ ‘র’-এর এজেন্ট বলে মনে করেন। এটা পাকিস্তানের মনস্তত্ত্বের গভীরে নিহিত। এক বার আমেরিকার সংবাদপত্রে পাকিস্তানের নাম দিয়েছিল ‘প্যারানয়েডিস্তান’। কারণ, ‘প্যারোনিয়া’ একটা মানসিক ব্যধি, যেখানে রোগী সর্বদাই সন্দিগ্ধচিত্ত। পাকিস্তান রাষ্ট্র সর্বদাই মনে করে, আমেরিকা এবং ভারত সদাসর্বদা তলে তলে গোপন সমঝোতা রক্ষা করে চলে। এই প্রসঙ্গেই আগামী প্রজাতন্ত্র দিবসে নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে বারাক ওবামার এ দেশে আসার উদাহরণ মনে আসছে। ভারতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার পরে ওবামা টেলিফোনে নওয়াজ শরিফকেও সে কথা জানান। বলেন, তিনি ভারত সফরে যাবেন। এর পরেই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় কাশ্মীর নিয়েও আলোচনা হবে। কিন্তু, আমেরিকা ফের এক বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, মোদীর আমন্ত্রণে ওবামা যে ভারত সফরে যাবেন, সে কথাই পাকিস্তানকে বলা হয়েছিল, অন্য কথা নয়। মজার কথা হল, কাশ্মীর প্রসঙ্গে পাকিস্তান সর্বদাই তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা চায়, কিন্তু ভারত একেবারেই তা চায় না। ভারত বরং চায় পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনা চালাতে। বস্তুত, পাকিস্তান যদি তাদের ওই মনোভাব ঝেড়ে ফেলে ভারতের সঙ্গে সরাসরি সদর্থক আলোচনা চালাত, তা হলে বিষয়টি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হত।

ভারতের তুলনায় পাকিস্তান অনেক ছোট রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতীয় মনস্তত্ত্বেও পাকিস্তান মানে সন্ত্রাস, এমন একটা আতঙ্ক তো আছেই। জিন্নার সঙ্গে দেখা করতে জওহরলাল নেহরু পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল এর ঘোরতর বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত নেহরু পাকিস্তান যেতে পারেননি। কারণ অবশ্য ছিল ভিন্ন। তিনি অসুস্থও হয়ে পড়েন সেই সময়। ভি পি মেননের রচনায় নেহরু-পটেলের এই মতপার্থক্যের কথা জানা যায়। কার্গিল যুদ্ধের পরেও অটলবিহারী বাজপেয়ী সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আডবাণী আপত্তি করেন। সে বার সার্ক সম্মেলন বয়কট করে ভারত, সম্মেলনই ভণ্ডুল হয়ে যায়। মনমোহন সিংহও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুম্বইয়ের ২৬/১১-র ভয়াবহ নাশকতার পরেও পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সনিয়া গাঁধী তথা কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা এতে রাজি হননি।

নরেন্দ্র মোদী সার্কে গিয়ে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে এ বার দেখা করবেন কি করবেন না, এটাই এখন মুখ্য প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত মোদী কী করবেন তা এখনও জানি না। কিন্তু ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান হিসেবে বারাক ওবামা এ দেশে আসার আগে সার্ক সম্মেলনে বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়াও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে শান্তিপ্রয়াসের ইতিবাচক সঙ্কেত— এমনটা অনেক কূটনীতিকের ধারণা। কূটনীতির চাপ, নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব রাজনীতি এ সব আলোচনা সরিয়ে রেখেও একটা বড় প্রশ্ন তুলি। সেটি হল, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তিন-তিনটি সাবেকি যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কার্গিলের যুদ্ধটিও পুরোপুরি একটি যুদ্ধ তো! তা হলে আজ দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র কী করবে? তারা কি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাধানের রাস্তা পেতে পারে? যুদ্ধ কারা চায়? অস্ত্র ব্যবসায়ী চায়, তার অস্ত্র বিক্রি হবে। কট্টরবাদীরা চায়, দাঙ্গাবাজেরাও চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি কখনও কোনও স্তরে যুদ্ধ চাইতে পারে? সমস্যার সমাধান সর্বদাই আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। শান্তি প্রক্রিয়ার কোনও বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক দেশের সকল রাষ্ট্রপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সে ছিল এক মাস্টারস্ট্রোক। নওয়াজ শরিফের সঙ্গে একান্তে কথাবার্তাও হয়েছিল। কিন্তু তার পর পাক হাইকমিশনে হুরিয়তদের সঙ্গে বৈঠকের ঘটনায় নারাজ সরকার বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দেয়। বহু কূটনীতিকের মতো আমারও মনে হচ্ছে, ভারতের পাকিস্তান নীতিতে ধারাবাহিকতা রাখাটা বিশেষ জরুরি। ‘কভি খুশি কভি গম’ নীতি নিয়ে চলাটা সুষ্ঠু কূটনীতি নয়। ভারত-পাক সম্পর্কটা যেন তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা আর নামা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারংবার।

ঐতিহাসিক আয়েষা জালাল তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘দ্য স্ট্রাগল ফর পাকিস্তান— আ মুসলিম হোমল্যান্ড অ্যান্ড গ্লোবাল পলিটিক্স’-এ অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক ব্যবস্থা আর গণতন্ত্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবে ‘অসহজ’, এ কথা আয়েষা বার বার বলেন। কিন্তু নওয়াজ ফের ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে টাফট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরি রিচার্ডসন প্রফেসর আয়েষা বলছেন, ‘ইভন অ্যাজ পাকিস্তান গ্র্যাপলস উইথ রিলিজিয়াস এক্সট্রিমিজম, রিজিওনাল ডিসিডেন্স অ্যান্ড আ সোয়ার্ম অফ পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক চ্যালেঞ্জেস অপারচুনিটিস হ্যাভ লেটলি অ্যারাইজেন ফর পাকিস্তান টু লিভ দ্য স্টেট অফ মার্শাল রুল বিহাইন্ড।’ আয়েষা বলছেন, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর পাকিস্তানের ‘জিওস্ট্র্যাটেজিক’ অবস্থানকে ব্যবহার করার প্রাসঙ্গিকতা অনেক কমেছে, সেনাবাহিনীর গুরুত্ব কমেছে। পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানে সেনা ও নগর সমাজের সম্পর্কেও নতুন ভাবনা আসছে।

আসলে, পাকিস্তানের শরীরের মধ্যেও তো আছে অনেক পাকিস্তান। আইএসআই-সেনার পাকিস্তান, মোল্লাতন্ত্রের পাকিস্তান, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পাকিস্তান। তাই নওয়াজের নেতৃত্বে পাকিস্তানের খোলসের মধ্য দিয়ে যখন আর এক পাকিস্তান বিকশিত হতে চাইছে তখন বৃহৎ গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেক অনেক বেশি। মালিহা লোধি সম্পাদিত গ্রন্থ ‘পাকিস্তান— বিয়ন্ড দ্য ক্রাইসিস স্টেট’-এও অতীতে আয়েষা জালাল বলেছিলেন, পাকিস্তানের অতীত সমস্যা বুঝলে বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্ভব। পাকিস্তানের পরিচিতি হয়ে ওঠে সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর বলে। আফগানিস্তানে আইএসআই একদা ‘জিহাদ’ পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়। আর তাই আজ যখন আফগানিস্তানের আল-কায়দা ও তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে আমেরিকা, তখন পাক ভুমিকা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই। আয়েষার প্রশ্ন, পাকিস্তান জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর বলে যে ধারণা বিশ্বমানসে দৃঢ় হয়েছে, তা দূর করতে তাদের কি আরও বেশি দায়িত্ব নেওয়া উচিত নয়?

তা হলে পাকিস্তানেরও ভূমিকা আছে তাদের এই পরিচিতির প্রবল ধারণাকে (পারসেপশন) বিশ্বের কাছে বদলানোর, আবার ভারতেরও দায়িত্ব দেশের মধ্যে সন্ত্রাসের বিরোধিতা করতে গিয়ে পারস্পরিক শান্তিপ্রচেষ্টায় জল না ঢালা। দ্বৈত রণকৌশল নিয়ে চলতে হবে, কিন্তু শান্তির পথকে শেষ সমাধান বলে ভাবতেই হবে! নান্য পন্থা!

jayanta ghosal shahi samachar kargil war india pakistan conflict
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy