Advertisement
E-Paper

ভাষা আন্দোলন নিছক সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে ভাবে ঢাকার বাঙালিরা সরব, পশ্চিমবঙ্গ সে ভাবে নয়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালবাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে ভাবে ঢাকার বাঙালিরা সরব, পশ্চিমবঙ্গ সে ভাবে নয়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১

২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস নিয়ে প্রত্যেক বছর ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি সর্বত্র বিস্তর আলোচনা হয়। অনেক স্মৃতিচারণ, অনেক গবেষণা। এ সবই স্বাগত। এ বার রাজধানী দিল্লিতে সফদরজঙ্গের মাতৃমন্দির আয়োজন করেছিল ভাষা দিবস নিয়ে আলোচনা সভা। চিত্তরঞ্জন পার্কের শিবমন্দির-সহ বিভিন্ন জায়গাতে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনেও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। আর এ সবের মধ্যে বার বার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন কিন্তু নিছক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনটিকে বুঝতে গেলে গভীর ভাবে বুঝতে হবে দেশভাগের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অসাম্যের ইতিহাস।

দেশভাগ হওয়ার পর জিন্না বেশি দিন বাঁচেননি। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালান। নিজে উর্দু বলতে পারতেন না। জনসভায় ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন এক জন অনুবাদক। তিনিই জিন্নার বক্তব্য উর্দুতে অনুবাদ করে দিতেন। যখন ঢাকায় গিয়ে জিন্না বক্তব্য রাখেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বাঙালি চিৎকার করে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। ১৯৫১তে পাকিস্তানে প্রথম যে আদমশুমারি হয় তাতে দেখা যায়, মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলেন। উর্দুতে কথা বলেন ৭.১ শতাংশ। পঞ্জাবি ভাষাভাষির সংখ্যা ২৮.০৪ শতাংশ। ৫.৮ শতাংশ হিন্দি। পস্তু ৭.১ শতাংশ। আর বাকি ১.৮ শতাংশ ইংরেজি ও অন্য ভাষাভাষীর নাগরিক ছিলেন। সবার মিলিত হিসাব ১০৪.৫৪ শতাংশ। অনেকে নিজেদের দ্বিভাষী হিসাবে পরিচয় দেওয়ায় পরিসংখ্যান একশো ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা তথা প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিল উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী নাগরিক।

মহম্মদ আলি জিন্না বা লিয়াকত আলিদের মতো অধিকাংশ উচ্চ ও প্রভাবশালী পরিবার ছিল মোহাজির। সেই কারণে লিয়াকতের মন্ত্রিসভাকে মোহাজির মন্ত্রিসভা বলা হত। আর পাকিস্তানের জমিদার বাড়ির ছেলেরাই উচ্চশিক্ষিত হয়ে অধিকাংশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তারাই খান সেনাদের নিয়ন্ত্রণ করত। উর্দু বনাম বাংলার লড়াইতে এই আর্থিক বিভাজনই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

কলকাতার প্রবীণ সাংবাদিক শঙ্কর রায় সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ১৯৪৮-এ ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় সৈয়দ মুজতবা আলি লেখেন, পশ্চিম পাকিস্তান যদি বাংলাকে মর্যাদা না দেয় ও উর্দুকে এ ভাবে চাপিয়ে দেয় তা হলে কিন্তু এক দিন পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন হুমায়ুন কবীর। ওই লেখার পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। ছিল না কোনও স্লোগানও। তিনি কেবল পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন। সাংবাদিক শঙ্কর রায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রাজনীতির ছাত্র হিসাবে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। আলি সাহেবের স্ত্রী ঢাকা আকাশবাণীতে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। এই রচনার জন্য আলি সাহেবকে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে হয়। ভারতের নাগরিকত্ব নিতে হয়। কিন্তু, তাঁর স্ত্রী ওখানেই রয়ে যান। দশ বছর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি আলি সাহেবের। এই পরিস্থিতিতে একটি কথা বলা দরকার, ভাষা আন্দোলনের পিছনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের আর্থিক অসাম্য বড় কারণ ছিল। এই অসাম্যই পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বাঙালি সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। এবং সেই আন্দোলন থেকেই এক দিন জন্ম নেয় আওয়ামি লিগ।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জোহির রায়হান ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ নামে ছবি বানান। তিনি তাঁর ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ভাষা আন্দোলন কী ভাবে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। সেই সময়ে রায়হান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন বহু কমিউনিস্ট কর্মী ওই ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে দীর্ঘ দিন ধরে আওয়ামি লিগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।

দুই বাংলায় ভাষা দিবস পালন

কলকাতার কার্জন পার্ক। —নিজস্ব চিত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। ছবি: এএফপি।

অনেকেই অভিযোগ করেন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে ভাবে ঢাকার বাঙালিরা সরব রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সে ভাবে নয়। উল্টে আমরা হিন্দি জাতীয়তাবাদের শরণ নিয়েছি। অথচ, চেন্নাই শহরে তামিল ভাষার জন্য হিন্দি বিরোধী আন্দোলন যে ভাবে দিল্লিকে বেগ দিয়েছে, সে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা দেননি। গাঁধী এবং সুভাষ বসুর মধ্যে বিতর্ক রাজনৈতিক। কিন্তু হিন্দি বনাম বাংলার বিতর্ক সে ভাবে হয়নি। আর আজ তো আমরা সেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে।

বার বার অভিযোগ ওঠে যে ঢাকায় যে রকম ভাবে বাংলাভাষাকে মর্যাদা দিয়েছেন ওখানকার মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কোনও দিনই সেভাবে তার বাঙালি সত্ত্বাকে নিয়ে লড়াই চালায়নি। স্বাধীনতার পর বরং তামিল ভাষা নিয়ে চেন্নাইতে আন্দোলন হয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তামিল বিদ্রোহ সুবিদিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তো আজ কার্যত হিন্দিকে অনেক বেশি গ্রহণ করেছে। ধন্যবাদ বলিউডকেও। অমিতাভ বচ্চন আর শাহরুখ খান হিন্দিকে ‘মোদের গরব মোদের ভাষা’ হিসেবে অনেকটা জায়গা করে দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বাঙালি নিজেকে যতটা ভারতীয় মনে করে ততটা বাঙালি সত্ত্বাকে মর্যাদা দেয় না। বাঙালি সত্ত্বাকে জাগ্রত করতে গেলে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার অভিযোগ ওঠে। যে কারণে তেলগু দেশম বা তামিল মানিলা কংগ্রেসের মতো পশ্চিমবঙ্গে ‘আমরা বাঙালি জনপ্রিয় হতে পারে না। আঞ্চলিক দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস অথবা সিপিএম সেই রাজনৈতিক পরিসর দখল করে, কিন্তু তারা নিজেদের উত্তর রেনেসাঁ আলোকপ্রাপ্ত ভারতীয়ত্ব নিয়ে বেশি সচেতন।

বাংলা ভাষা ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, মৌর্য রাজাদের বঙ্গ বিজয়ের আগে বাংলাদেশে আর্যভাষার ও আনুষঙ্গিক উত্তর ভারতের, অর্থাৎ গাঙ্গেয় উপত্যকার সভ্যতার বিস্তার ঘটেনি। মৌর্য বিজয় থেকে গুপ্ত রাজবংশ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ থেকে খ্রিস্টীয় ৫০০ পর্যন্ত, এই আটশো বছর ধরে ভাষায় বাংলাদেশের আর্যীকরণ চলেছে। বাংলার অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ভাষী মানুষ নিজেদের অনার্যভাষা ত্যাগ করে ধীরে ধীরে আর্যভাষা অর্থাৎ মগধের প্রাকৃতভাষাকে গ্রহণ করে। এই যে বাঙালিদের আর্যত্বপ্রাপ্তি তা বাঙালি জাতির স্বকীয় সত্ত্বাকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক পরিসরে ক্ষতি করেছে কি না সে এক বিতর্কের বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই ভাষা চেতনা রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ দিয়েছে। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান লিখেছিলেন,

এই আমাদের আজকের শপথ।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

সেপাইরা ছুটে এসে চক্রাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের

সবার বুকের সামনে একটা করে রাইফেলের নল চিকচিক করছে

তবু চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠল

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

সূর্য উঠছে।

সূর্য ডুবছে।

সূর্য উঠছে।

সূর্য ডুবছে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

আর আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী, আমাদের কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, দেশ আমাদের কোনও মাতৃভাষা দেয়নি এখনও!

shahi samachar jayanta ghosal bhasa diwas shahi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy