Advertisement
E-Paper

‘ভয় পেয়ো না’ বললে হবে?

ভয় পাওয়া অনেক সময়েই স্মৃতির কারসাজি। সেই কারণেই ভয়ের কারণ না থাকলেও আমরা ভয় পাই। মস্তিষ্কবিজ্ঞানের আলোয় এই রহস্যের নতুন সূত্র উন্মোচিত হয়েছে। সেই গবেষণার ফল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের দুনিয়ায় স্বীকৃত হয়েছে।ভয় পাওয়া অনেক সময়েই স্মৃতির কারসাজি। সেই কারণেই ভয়ের কারণ না থাকলেও আমরা ভয় পাই। মস্তিষ্কবিজ্ঞানের আলোয় এই রহস্যের নতুন সূত্র উন্মোচিত হয়েছে। সেই গবেষণার ফল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের দুনিয়ায় স্বীকৃত হয়েছে।

সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেই মার্কিন সেনার দুর্দশা বিজ্ঞানের গবেষণায় এখনও আলোচিত হয়ে থাকে। এক ভয়ংকর স্মৃতি জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তাঁর। যুদ্ধ চুকেবুকে গেছে বহু কাল, তিনি ফেরত চলে এসেছেন আমেরিকায়। অথচ অকস্মাৎ বাজ পড়লে, বাঁশের তৈরি মাদুরে হাত দিলে, এমনকী এশীয় কোনও মহিলার মুখোমুখি হলেও মনের ফ্ল্যাশব্যাকে ঘুরেফিরে আসত অনেক দিন আগে ফেলে আসা সেই দৃশ্যটা। তিনি ভিয়েতনামের জঙ্গলে। অঝোরে বৃষ্টি। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে হাত-পা। অথচ শরীরে ঘাম। বাতাসে বারুদের গন্ধ। হঠাৎ চোখের সামনে এক নারকীয় দৃশ্য। বাঁশের তৈরি থালা। তাতে সতীর্থ সৈনিক ট্রয়-এর কাটা মুন্ডু। ভিয়েতনামি সেনা-ছাউনি থেকে পাঠানো ‘উপহার’।

ঘটনাটি কয়েক দশক পুরনো, ঘটেছিল বহু দূরের যুদ্ধক্ষেত্রে, তবু তার স্মৃতি টাটকা। সামান্য ছুতোয় হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসে। ফিরিয়ে আনে ত্রাস, একেবারে সে দিনের মতো। অকস্মাৎ ভয়ংকর মানসিক আঘাত-বিধ্বস্ত যে কোনও মানুষই এ রকম বিপদের শিকার হতে পারেন। তবে, যুদ্ধক্ষেত্র যেহেতু নারকীয়তার জবর আঙিনা, তাই সৈনিকদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। এ দশার পোশাকি নাম ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (পিটিএসডি)।

এমনটা কেন হয়? বেঙ্গালুরুতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস-এ আমি ও আমার ছাত্র সুপ্রিয় ঘোষের গবেষণায় এ ব্যাপারে নতুন দিশা মিলেছে। নিরাপদ এবং বিপদসংকুল সংকেতের প্রভেদ মস্তিষ্ক কী ভাবে গুলিয়ে ফেলে, সে ব্যাপারে। ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে আমরা বুঝতে পেরেছি, মস্তিষ্কের যে অংশ ভয়ের স্মৃতি ধরে রাখে, সেই ‘অ্যামিগডালা’ কী ভাবে কখনওসখনও কাজে ভুল করে। মানে, নিরাপদ সংকেতকেও ভীতিপ্রদ বলে ভেবে বসে।

একটা ‘নিরপেক্ষ’ সংকেতের (আলো বা আওয়াজের মতো) সঙ্গে একটা অনুভূতিকে জড়িয়ে ফেলার ব্যাপারটা জানা আছে বহু কাল। এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন রুশ বিজ্ঞানী ইভান পাভলভ। তিনি দেখেছিলেন, যে কুকুর একটা ঘণ্টার শব্দে উদাসীন থাকে, সে কিন্তু সেই শব্দের পর ঘরে খাবার আসতে দেখলে বদলে যায়। তখন শব্দটা তার জিভে লোভজনিত লালা আনে। কারণ, স্মৃতি তাকে বলে দেয় ঘণ্টার শব্দ মানেই খাবার আসছে। পাভলভ লক্ষ করেছিলেন, তাঁর কুকুর শুধু পরীক্ষায় ব্যবহৃত শব্দটি শুনেই নয়, তার কাছাকাছি অন্য শব্দ শুনেও লোভী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, পশুটি যে একাধিক শব্দকে সমান জ্ঞান করে, তা শুধু এ কারণেই নয় যে, সে ওদের পার্থক্য বুঝতে অপারগ। বরং এ কারণে যে, সে আশা করে, যে কোনও শব্দের ফলাফল সমান। ফল যদি পুরস্কারের বদলে হয় কঠিন শাস্তি, বা কোনও বিপদ, তবে কিন্তু প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সত্যিকারের বিপদের সংকেতকে পাত্তা না দিলে দুর্ভোগের সম্ভাবনা, সত্যিকারের পুরস্কারের সংকেতকে বিপজ্জনক ধরে নিয়ে এড়িয়ে গেলে খাবার হাতছাড়া। সংকেত ঠিকঠাক বোঝা, অতএব, খুব জরুরি।

আমরা পাভলভের পরীক্ষার ধরনটা একটু বদলেছিলাম। একটা শব্দের বদলে এক জোড়া আলাদা শব্দ শুনিয়েছিলাম ইঁদুরদের। একটা শব্দের সঙ্গে যুক্ত ছিল মৃদু ইলেকট্রিক শক। মানে বিপদ। অন্যটার সঙ্গে কিছুই যুক্ত ছিল না। মানে, তা নিরাপদ। দেখলাম, ইঁদুরেরা দ্রুত শিখে ফেলছে দু’রকম শব্দের প্রভেদ। যেটাতে বিপদ, তাকে ওদের ভয়, অন্যটায় থোড়াই কেয়ার।

হচ্ছেটা কী? তা জানা গেল অ্যামিগডালা-য় স্নায়ুকোষের পাঠানো বৈদ্যুতিন সংকেত রেকর্ড করে। দেখলাম, ওখানকার প্রচুর স্নায়ুকোষ বিপদের সঙ্গে যুক্ত শব্দে বেশি মাত্রায় সক্রিয় হচ্ছে। অল্প কিছু কোষ অবশ্য আগুয়ান পরিস্থিতি বিপজ্জনক না নিরাপদ, তার ফারাক করতে পারছে না। দুটি শব্দেই সমান সাড়া দিচ্ছে। তবে তেমন কোষের সংখ্যা নেহাত কম। তারাই সংখ্যায় বেশি, যারা বিপদকে আগেভাগে চিনতে পারছে। এ বার আমরা দেখতে চাইলাম, ঘন্টির শব্দের সঙ্গে যুক্ত আঘাতের পরিমাণ বাড়ালে কী হয়। ফলাফল বিশেষ লক্ষণীয়। দেখলাম, নিরাপদ শব্দকে, মানে যার সঙ্গে ইলেকট্রিক শক যুক্ত নয়, তাকে এ বার ইঁদুরেরা আর আলাদা করে চিনতে পারছে না, বরং তাতেও ভয় পাচ্ছে। শকের পরিমাণ বেশি মানে, বিপজ্জনক আর নিরাপদের ফারাক না বুঝলে দণ্ড বেশি দিতে হবে— এটা জেনে ইঁদুর এ বার বেশি সাবধানী। যেখানে বিপদ নেই, সেখানেও তা কল্পনা করে নিয়ে আরও বেশি সতর্ক।

এবং অ্যামিগডালাতেও পরিবর্তনের চিহ্ন। দেখলাম, আগে বিপজ্জনক আর নিরাপদের ফারাক করতে পারত যত স্নায়ুকোষ, তার পাঁচ-ছয় গুণ কোষ এ বার তা পারছে না। ঘন্টির শব্দের সঙ্গে ইলেকট্রিক শক যুক্ত থাক বা না থাক, তারা সমান সক্রিয় হয়ে উঠছে। সুতরাং বিপদের মাত্রা বাড়লে অ্যামিগডালার স্নায়ুকোষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে যাচ্ছে। অ্যামিগডালার কোষগুলির ভিতরেই ভয় আর অভয়ের তফাত লুকিয়ে আছে। কোনও সংকেতে ভয় পাওয়া বা না পাওয়ার ক্ষেত্রে এক-একটা স্নায়ুকোষে কী কী খেলা চলে, তা বোঝার ব্যাপারে আমাদের গবেষণা এক বড় পদক্ষেপ।

বড়সড় মানসিক আঘাত কিংবা প্রাণসংশয় থেকে যে পিটিএসডি-র জন্ম হয়, তার মূলে স্নায়ুকোষের ভূমিকা কেমন, তা অনেকটা জানা গেল এ বার। এখন যার নাম পিটিএসডি, তাকে এক সময় সৈনিকদের ক্ষেত্রে বলা হত ‘শেল-শক’। গোলাবারুদের শব্দে আতংকজনিত আঘাত। পিটিএসডি এখন আর শুধু সেনাদের সমস্যা নয়। যৌন অত্যাচার, দুর্ঘটনা কিংবা সন্ত্রাসবাদের শিকার মানুষজনের ক্ষেত্রেও ওই মানসিক বিপর্যয় প্রায়ই দেখা যায়। এ রকম রুগির মনের পরদায় হঠাৎ ফুটে ওঠে পুরনো আঘাতের স্মৃতি। তুচ্ছ, এমনকী বিনা কারণেও। কেন এমন হয়, তা জানতে অ্যামিগডালার নানা রকম ‘ছবি’ (এমআরআই-এর মাধ্যমে) তুলে আগে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন গবেষকেরা। তবে বেশি দূর এগোতে পারেননি।

আমরা দেখালাম, স্নায়ুকোষে বৈদ্যুতিন সংকেতের হেরফের কী ভাবে অ্যামিগডালার অতিসক্রিয়তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা থেকে পিটিএসডি প্রশ্রয় পায়। তা ছাড়া অ্যামিগডালায় সংকেত আদানপ্রদানে জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার ভূমিকাও অনেকটা বোঝা গেল। এর থেকে ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হতে পারে পিটিএসডি মোকাবিলার কৌশল।

ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস (বেঙ্গালুরু)’তে মস্তিষ্কবিজ্ঞানের শিক্ষক

editorial sumantra chattopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy