Advertisement
E-Paper

মৃত্যু আর মহোত্‌সব

যদি অস্ট্রেলিয়া ভারতে ক্রিকেট সিরিজ খেলতে যেত, আর তখন কোনও ভারতীয় প্লেয়ারকে নিয়ে এই রকম...প্রমাণ করিলাম, মরি তো নাই-ই, বরং বেঁচে থাকার চেয়ে সাতাশি গুণ পাবলিসিটি! মরে গেছি বলে দুঃখু হচ্ছে খুব, এত কম বয়সেই দি এন্ড এল, কত কীর্তি, আনন্দ, অভিজ্ঞতা স্টোরে রাখা ছিল, কত আশ্চর্য ঘটনায় নিজেকে ছুপিয়ে নেওয়া যেত!

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০

প্রমাণ করিলাম, মরি তো নাই-ই, বরং বেঁচে থাকার চেয়ে সাতাশি গুণ পাবলিসিটি! মরে গেছি বলে দুঃখু হচ্ছে খুব, এত কম বয়সেই দি এন্ড এল, কত কীর্তি, আনন্দ, অভিজ্ঞতা স্টোরে রাখা ছিল, কত আশ্চর্য ঘটনায় নিজেকে ছুপিয়ে নেওয়া যেত! কিন্তু এ-ও ঠিক, সারা জীবন চেষ্টা করলেও আমার চার দিকে এমন আদিখ্যেতা প্রদক্ষিণের ব্যবস্থা বাগাতে পারতাম কি? উরেব্বাপরে বাপ, বাউন্সারে মাথা থেঁতলেছে বলে অ্যাক্কেবারে চিরপ্রণম্য হিরো! সব এমন কাঁদছে যেন আমিই নিশ্চিত ব্র্যাডম্যান, আমিই নিখাদ প্রাইম মিনিস্টার, আমার ভরসাতেই মহাদেশের সকল ক্যাঙারু ও তার পকেটের ছানা বাঁচছিল। দেশের পতাকা অর্ধনমিত থাকছে, সারা দেশ হাঁ করে কাজকম্ম শিকেয় তুলে টিভিতে আমার অন্ত্যেষ্টি দেখছে, ভালই লাগছে, কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে আবার আবেগকে নিয়ে সন্দেহ হয়।

এটুকু হলফ করে বলতে পারি, যদি অস্ট্রেলিয়া ভারতে ক্রিকেট সিরিজ খেলতে যেত, আর তখন কোনও ভারতীয় প্লেয়ারকে নিয়ে এই রেটে বারোয়ারি মড়াকান্নার রোল উঠত, এ আছাড়িপিছাড়ি খায় তো ও দেওয়ালে মাথা ঠোকে, এ বক্তৃতা দিতে গিয়ে গলা ধরিয়ে ফেলে তো ও শোকপ্রস্তাব পাঠ করতে রোগশয্যা থেকে লাফিয়ে উঠে আসে, ক্রিকেটকর্তারা পারলে ক্রিকেটটাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জবাবদিহি চান, বল কেন মারলি দুধের ছানাটিরে তা হলে আমাদের টিমে বিকট হাসাহাসি পড়ে যেত। আমরা আঙুল দেখিয়ে বলতাম, দ্যাখ দ্যাখ, এই ব্যাটা তৃতীয় বিশ্ব, সারা ক্ষণ আবেগ ফাঁপিয়ে বাঁচে, যে কোনও অজুহাতে মোলোড্রামা করতে পেলে আর কিচ্ছু চায় না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ফোকাস করার চেয়ে, নিজেকে অবান্তর স্রোতে বইয়ে দেওয়ার ফাঁকিবাজি এদের জাপটে আছে। আর আমাদের দ্যাখো, গর্বিত উন্নত সায়েবের দল, চরম বিপর্যয়কেও নির্বিকার ভাবে গ্রহণ করি। রাগ শোক দুঃখু সবই আলোড়িত করে, কিন্তু মুখে, বা কর্তব্যে, রুটিনে, ছায়াই পড়তে দিই না। কারণ আমরা জানি, যা-ই ঘটুক, দ্য শো মাস্ট গো অন। একটা ক্রিকেটারকে বরং তখনই ঠিকঠাক শ্রদ্ধা জানানো যাবে, যখন সে যে খেলাটা ভালবেসে খেলেছিল, সেটাকে সাড়ম্বরে উদযাপন করব। ক্লার্ক অবশ্য বক্তৃতায় এই গোছের একটা কথা বলেওছে, কিন্তু কাজে এরা টেস্টটাকে পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা হলে বলতাম, কেন? শ্রদ্ধা জানাতে চাও তো টেস্ট এগিয়ে আনো! আরও তাড়াতাড়ি সেই খেলাটা খেলতে নেমে পড়ো, যা তোমাদের বন্ধু অ্যাত্ত ভালবাসত!

কিন্তু এখন আমরাই বলিউডের বাবা হয়ে গেছি। আমি বিরাট ক্রিকেটকীর্তি স্থাপন করেছিলাম কি না, সে সব না ভেবে, স্রেফ মরে যাওয়াটা নাটকীয় ও ট্র্যাজিক বলে, ফোঁপানির কম্পিটিশন চলছে। আসলে, পৃথিবীর এখন রোজ রোজ ইভেন্টের বড্ড দরকার। ব্রেকিং নিউজের দায় এসে সব্বাইকে খুব হড়কে রেখেছে। আর সম্মিলিত হাহাকারের আকর্ষণ মানুষের কাছে খুব, বোধহয় স্টেডিয়ামের সবাই মিলে চিল্লাবার মতোই একটা দারুণ ছোঁয়াচে হিস্টিরিয়া-উত্‌সব হয়। ক’দিন আগেও অবশ্য সবার সামনে কান্না আড়াল করার একটা চল অন্তত পুরুষদের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন মেট্রোসেক্সুয়াল হওয়ার ফ্যাশন এসেছে, ‘মাচো’ ইমেজকে কলা দেখিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে বোঝাতে হয়, পুংশাসিত সমাজের স্টিরিয়োটাইপ ভেঙে বেরিয়ে এসেছি, আমার মধ্যেকার ফেমিনিন সাইডকে এই আলিঙ্গন করলেম। ফেমিনিন-এর আগে একটা ‘তথাকথিত’ লাগাতে হবে, নইলে আবার অ্যাকাডেমিক ঝাড়। মোদ্দা কথা, ভ্যঁা ভ্যঁা কাঁদব, তালি কুড়োব। কে বললে ইমোশনকে গোপন করার মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের বাহাদুরি আছে? মঞ্চে পোডিয়ামে ভ্যাড়ভ্যাড় করে আবেগ উগরে দিলে ক্ষতি কী? রাজপথে আজি ফ্লাড হয়ে যাক।

এতে ব্যাপক সুবিধে। প্রথমত, এর পর আমার কাজটা ঠিক করে না পারলে, ককিয়ে সাফাই গাওয়া যায়, আমার কি কাজের অবস্থা আছে গো? আমি যে দুঃখু মানাচ্ছি! কী করে ভাবলে এই শোক-ঝাপসা চোখে অফস্টাম্প দেখতে পাব? আর কাজ ঠিক উতরে গেলে বলা যায়, দেখেছ, অ্যঁা, এই বিদীর্ণ হৃদয় লয়েও সেঞ্চুরি! মুড ভাল থাকলে ডবল ট্রিপ্ল কোথায় গিয়ে থামতেম কে জানে? সর্বোপরি, যে লোকটাকে সবাই ক্যাপ্টেন্সি থেকে ধাক্কা মেরে তাড়াবার প্ল্যান করছিল, সারা দেশ যার ওপর খেরে ছিল, প্রথম টেস্টে যার না খেলা প্রায় নিশ্চিত ছিল, তাকে শুধু কান্নার গ্যালন মেপে সবাই ক্যাপ্টেন মাই ক্যাপ্টেন বলে মালা পরিয়ে বেদিতে চড়িয়ে হুররে দিতে কূল পায় না!

খেলার আগে মৌন পালন আর কালো ব্যান্ড পরা, সে তো হবেই। কিন্তু আমি অস্ট্রেলিয়ার ৪০৮তম প্লেয়ার ছিলাম বলে গোটা টিমের জার্সিতে ৪০৮ লেখা, বা আমাকে থার্টিন্থ ম্যান হিসেবে খেলোয়াড়ের লিস্টে রাখা! তার পর আবার সংখ্যার হায়ারার্কিতে বিপ্লব! অ্যাদ্দিন পৃথিবীতে শুধু ‘০’ বা ‘৫’ দিয়ে শেষ সংখ্যাদের হেভি সম্মান ছিল। লোকে মহাপুরুষদের ১০০, ১৫০, ১৭৫ বছর হইহই করে পালন করত। কিন্তু এ বার ‘৩’ দিয়ে শেষ একটা সংখ্যা ম্যান অব দ্য ম্যাচ! মরে যাওয়ার আগে ৬৩-তে নট আউট ছিলাম বলে টেস্ট শুরুর আগে ৬৩ মিনিট ধরে হাততালি! এ তো চেটোর স্কিন ছুলে যাবে রে! আবার ওয়ার্নার ৬৩ করে ব্যাট তুলল! যা আজ অবধি শুধু ৫০ আর ১০০-র পাওনা ছিল! ক্লার্ক এ খেলায় ফাটিয়ে দেবে বলেই নেমেছে, সে ৩৭ করেই ব্যাট তুলল, কারণ ১০০ হতে আর ৬৩ বাকি! উরিব্বাস! এমন বিয়োগ ভেবে পেলি ড্রেসিংরুমে! এ বার তো স্ট্রাইকার ৯ আর নন-স্ট্রাইকার ৭ করলে দোঁহে মিলে ব্যাট তোলাতুলি মচাবি রে, ওগুলো গুণ করলে ৬৩ হয়! কিংবা, খেলতে নেমে ক্রিজে স্টান্স নিয়েই ব্যাট তোল না, কারণ ৬৩ করতে আর মাত্র ৬৩ বাকি!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy