Advertisement
E-Paper

মোদী ও মেকলে

অম্বিকেশ মহাপাত্রের ঐতিহাসিক লাঞ্ছনার দায়িত্ব অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের সর্বময়ী কর্ত্রীর, ইতিহাস তাঁহার সেই দায় ভুলিবে না। কিন্তু সেই পীড়ন যে বিধানের জোরে সম্ভব হইয়াছিল তাহাও সম্পূর্ণ অন্যায়, এবং সেই অন্যায়ের দায় মনমোহন সিংহ ও তাঁহার সরকারের, কারণ তথ্য প্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ৬৬এ ধারাটি সেই সরকারের আমলেই সঞ্জাত।

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

অম্বিকেশ মহাপাত্রের ঐতিহাসিক লাঞ্ছনার দায়িত্ব অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের সর্বময়ী কর্ত্রীর, ইতিহাস তাঁহার সেই দায় ভুলিবে না। কিন্তু সেই পীড়ন যে বিধানের জোরে সম্ভব হইয়াছিল তাহাও সম্পূর্ণ অন্যায়, এবং সেই অন্যায়ের দায় মনমোহন সিংহ ও তাঁহার সরকারের, কারণ তথ্য প্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ৬৬এ ধারাটি সেই সরকারের আমলেই সঞ্জাত। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মতো প্রযুক্তি-মাধ্যম ব্যবহার করিয়া কেহ যদি এমন কিছু প্রচার করেন যাহাতে অন্য কাহারও ‘বিরক্তি, অসুবিধা’ ইত্যাদি উত্‌পন্ন হয়, তাহা হইলে এই ধারা মোতাবেক শাস্তি হইতে পারে। এমন আইন থাকিলে ভারতের মতো দেশে তাহার অপব্যবহার অনিবার্য। তাহার কারণ, গণতন্ত্র এ দেশের শাসকদের অনেকেরই মজ্জায় প্রবেশ করিতে পারে নাই, কেহ তাঁহাদের বিরাগ উত্‌পাদন করিলেই তাঁহারা কুপিত হন এবং সেই কোপ রাজদণ্ড হইয়া ‘অপরাধী’র উপর নামিয়া আসে। পাশ্চাত্য শিবসেনা হইতে প্রাচ্য তৃণমূল কংগ্রেস— অসহিষ্ণুতা ও প্রতিশোধস্পৃহা একটি সর্বভারতীয় ব্যাধি। ব্যাধিগ্রস্তের পক্ষে এই আইন বিপজ্জনক।

মূল প্রশ্নটি গভীরতর। অপব্যবহার হউক বা না হউক, একটি গণতান্ত্রিক দেশে এমন আইন আদৌ থাকিবে কেন? সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে এই প্রশ্নই নিক্ষেপ করিয়াছে। সর্বোচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ, কেন এই দুই ধারা তথ্য প্রযুক্তি আইনে সংযোজিত হইয়াছিল, সরকারকে সাত দিনের মধ্যে তাহার উত্তর দিতে হইবে, নচেত্‌ আদালত তাহার প্রয়োগে স্থগিতাদেশ জারি করিবে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার যদি গণতন্ত্রের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাশীল হন, তবে সাত দিন কেন, এই নির্দেশের সদুত্তর খুঁজিতে সাত মিনিটও সময় লাগিবার কারণ নাই। এই ধারাগুলির কোনও যৌক্তিকতা নাই, কোনও প্রয়োজনও নাই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করিলে এই ধরনের আইন পত্রপাঠ রদ করা কর্তব্য। ইউপিএ সরকারের অপকর্মের বোঝা বহন না করিয়া অবিলম্বে আইন সংশোধনে উদ্যোগী হওয়া জরুরি।

এমন ভয়ানক অন্যায় আইন যখন সংসদে প্রণীত হইয়াছিল, তখন সেখানে কোনও আপত্তি উঠে নাই। এ দেশে তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণার ঘোর অনটন। তাহা না হইলে সংসদে একটি সহজ প্রশ্ন উঠিত: ‘বিপজ্জনক’ কথা বা ছবির প্রচার রোধ করিতে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যে ব্যবস্থা আছে, তাহার উপরে আলাদা করিয়া তথ্য প্রযুক্তি আইনে সে জন্য মাথা ঘামাইতে হইবে কেন? কম্পিউটার বা মোবাইল টেলিফোন তো এক একটি মাধ্যম বই কিছু নহে, তাহার জন্য স্বতন্ত্র আইন সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। বস্তুত, শুধু এই আইন নহে, ভারতে এখনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর নানা ধরনের আইনি নিয়ন্ত্রণ জারি রহিয়াছে, মানহানি সংক্রান্ত আইন বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পদাধিকারীর অবমাননা সংক্রান্ত বিধানের অধিকাংশই অনৈতিক। অহেতুকও। যথার্থ প্রয়োজন মিটাইতে শ্রীযুক্ত মেকলেই আজও যথেষ্ট। উনিশ শতকে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে’র নেতৃত্বে গঠিত ল কমিশনের (১৮৩৪) সুপারিশের ভিত্তিতে যে ভারতীয় দণ্ডবিধি (১৮৬০) প্রণীত হয়, প্রশাসকরা দক্ষ এবং নিরপেক্ষ থাকিলে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য এখনও তাহার অধিক বিশেষ কিছুর দরকার হয় না। ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক সুশাসন’-এর প্রচারক নরেন্দ্র মোদী মেকলে’তে ফিরিয়া চলুন, অবান্তর আইনগুলিকে ছাঁটিয়া ফেলুন, ইতিহাসে দাগ রাখিয়া যাইতে পারিবেন।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy