Advertisement
E-Paper

মানবিক রায়

বিচারাধীন বন্দিদের অনন্ত কাল জেলে পচাইবার অমানবিকতার বিরুদ্ধে এ বার খড়্গহস্ত হইয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির এক বেঞ্চ রায় দিয়াছে, সারা দেশের বিভিন্ন জেলখানায় বিচারাধীন যে বন্দিরা তাঁহাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগ প্রমাণিত হইলে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সাজার অর্ধেক ইতিমধ্যেই খাটিয়া ফেলিয়াছেন, তাঁহাদের মুক্তি দিতে হইবে, অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাব্য মামলাগুলি বাদ দিয়া।

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১

বিচারাধীন বন্দিদের অনন্ত কাল জেলে পচাইবার অমানবিকতার বিরুদ্ধে এ বার খড়্গহস্ত হইয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির এক বেঞ্চ রায় দিয়াছে, সারা দেশের বিভিন্ন জেলখানায় বিচারাধীন যে বন্দিরা তাঁহাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগ প্রমাণিত হইলে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সাজার অর্ধেক ইতিমধ্যেই খাটিয়া ফেলিয়াছেন, তাঁহাদের মুক্তি দিতে হইবে, অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাব্য মামলাগুলি বাদ দিয়া। ইহার ফলে প্রায় চার লক্ষ বিচারাধীন বন্দির মধ্যে অন্তত আড়াই লক্ষকে দ্রুত মুক্তি দিতে হইবে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা বিচারপতিরা ওই সব বন্দিকে শনাক্ত করিবেন এবং যথাবিহিত পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া তাঁহাদের মুক্তির নির্দেশ দিবেন। শীর্ষ আদালতের এই রায় অভিনন্দনযোগ্য। মানবাধিকার আন্দোলনের এক দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হইল।

স্বাভাবিক ন্যায়ের দাবিও। বস্তুত, ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধিতেই ৪৩৬/ক ধারায় অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির অর্ধেক ভোগ করিয়া ফেলিলে ছাড়িয়া দিবার বিধান রহিয়াছে। বিচারাধীন বন্দি এবং বিনা বিচারে আটক বন্দি কার্যত একই ব্যাপার। অন্তত বন্দির কাছে এই দুইয়ের মধ্যে কোনও তফাত নাই। ভারতের মতো দেশে এ ধরনের অধিকাংশ বন্দিই ছোটখাটো অপরাধের দায়ে আটক। বিচারপ্রক্রিয়া না চলিলে কিংবা চলাকালেও তাঁহাদের অনেকেরই জামিনে মুক্ত থাকার কথা। তবু তাঁহারা জেলের ঘানি টানিতেছেন, কেননা অধিকাংশ বন্দির জামিন বাবদ দেয় অর্থ আদালতে জমা রাখার মতো সঙ্গতি নাই। অর্থাৎ অপরাধের গুরুত্ব নয়, দারিদ্রই তাঁহাদের দীর্ঘ ও বিচারাধীন বন্দিত্বের কারণ। আদালতের অভাব, বিচারকের অভাব, দরিদ্র অভিযুক্তদের মামলা হাতে লইতে আইনজীবীদের অনাগ্রহ— এই সবের মিলিত ফল হইল বিচারাধীন বন্দিদের দীর্ঘ হাজতবাস। ইহার দায় সমাজ বা রাষ্ট্র, কেহই লয় না। অথচ প্রতিটি মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রহিয়াছে। বিশেষত গণতন্ত্রে এ জন্যই বিনা বিচারে আটক রাখার আইনগুলির বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদ ওঠে। বিনা বিচারে কাহাকেও আটক রাখা সেই ব্যক্তির মানবাধিকার লঙ্ঘন করা, তাহার নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকারও লঙ্ঘন করার শামিল। কোনও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাহার নাগরিকদের জন্য এমন স্বেচ্ছাচারী বন্দোবস্ত চালু রাখিতে পারে না।

কারাবাস ও বন্দিত্ব ব্যক্তিকে তাহার পরিবার ও প্রিয়জন হইতে, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক হইতে বিচ্ছিন্ন করে। জেলখানার ভিতর তাহার নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের সহিত যুক্ত হয় জেল-কর্তৃপক্ষ ও ওয়ার্ডারদের দমননীতি ও নির্যাতন, প্রায়শ সহবন্দিদের হেনস্থা ও হয়রানি, যাহা বন্দির দিনযাপনের গ্লানি বাড়াইয়া দেয়। কোনও বিচার ব্যতীত পাঁচ-সাত বছর এই ভাবে জেলখানায় থাকিতে থাকিতে নিরপরাধ মানুষও মানসিক অবসাদগ্রস্ত হইয়া পড়ে, কেহ কেহ অপরাধ জগতের সঙ্গেও যুক্ত হইয়া যায়, যে-জগৎ জেলের বাহিরের মতোই জেলের অভ্যন্তরেও সমান সক্রিয়। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের দাক্ষিণ্যে এই সব বন্দিরা জেলের অন্ধকার হইতে বাহিরের মুক্তির আলোয় পা রাখিলেও তাহাদের মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা, কাউন্সেলিং প্রভৃতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু যাহারা জামিনের টাকা জোগাড় করিতে না-পারায় জেল খাটিয়া মরে, তাহারা মনঃসমীক্ষকের চেম্বারে যাওয়ার অর্থ কোথায় পাইবে? এ ব্যাপারে তাই শীর্ষ আদালত সরকারকে, জেল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy