Advertisement
E-Paper

মূঢ় যুবরাজ ও ভ্রান্ত বামপন্থীদের উপহার

ঝাড়খণ্ডের শ্রেণিভিত্তিক প্রেক্ষাপটকে বামপন্থীরাও চিনতে পারলেন না, এই ব্যাপক শ্রমজীবীদের কাছে নিজেদের গ্রহণীয় করে তোলার উদ্ভাবনী প্রয়াসও করলেন না, গোটা বিষয়টাকে পরিচিতি-ভিত্তিক একটা ব্যাপার বলে অস্পৃশ্য রেখে দিলেন।বিহার-উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা উপনির্বাচনে যে ঈষত্‌ সন্দেহ তৈরি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ দূরীভূত: মহারাষ্ট্রের পর ঝাড়খণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনে ‘মোদী ঝড়’ নামক লব্জটি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
বদল। নতুন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস (বাঁ দিকে) ও ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। পিটিআই

বদল। নতুন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস (বাঁ দিকে) ও ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। পিটিআই

বিহার-উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা উপনির্বাচনে যে ঈষত্‌ সন্দেহ তৈরি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ দূরীভূত: মহারাষ্ট্রের পর ঝাড়খণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনে ‘মোদী ঝড়’ নামক লব্জটি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যে শুধু ২৫ আসন নয়, ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে এই ভাবে উঠে আসা, এতেও যদি মোদী নাম-মাহাত্ম্যে কারও অবিশ্বাস থাকে, তার জন্য তো ঝাড়খণ্ড আছেই। রাজনৈতিক অস্থিরতার পরাকাষ্ঠা, বিপুল সম্পদশালী কিন্তু ভয়াবহ দারিদ্র কবলিত এই রাজ্যটিতে আসনের নিরিখে বি জে পি-র ক্ষমতা বাড়ল দুই গুণের বেশি: ১৮ থেকে ৩৭, জোটসঙ্গী আজসু-র পাঁচ আসনের সাহায্যে স্থায়ী মন্ত্রিসভা গঠনের নিশ্চয়তা। অতএব, ভারত মোদীময়। মোদী ভারতময়।

নামকীর্তন ছেড়ে একটু ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে অবশ্য অনেক আলোচনার, বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ থাকে। আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে অমোঘ মনে হচ্ছে, আসল ব্যাপারটা তার থেকে অন্য রকমও মনে হতে পারে। দূরের জম্মু ও কাশ্মীরের জটিলতাগুলোতে না-ও যদি যেতে পারি, পড়শি ঝাড়খণ্ডের সরল অঙ্কগুলো থেকেও আমরা কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের বহুমাত্রিক স্বরূপটার কিছু পরিচয় পেতে পারি।

প্রথমত, ঝাড়খণ্ডে বিজেপি বৃহত্তম দল হলেও, ভোটের আনুপাতিক হিসেবে (৩১ শতাংশ) তার সমর্থনভিত্তি এক-তৃতীয়াংশতেও পৌঁছতে পারেনি। জোটসঙ্গী আজসু-র ভোট যোগ করার পরও এই ভিত্তি মাত্র ৩৫ শতাংশ। তবু যে তার বিধায়ক সংখ্যায় বিপুল বৃদ্ধি ঘটল, তার প্রধান কারণটা তো ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া। হিসেব থেকে মোটামুটি যা দেখা যাচ্ছে, আগের সরকারের শরিক দলগুলো যদি আলাদা আলাদা না লড়ত, তা হলে অন্তত ডজনখানেকের বেশি আসনে বিজেপি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারে।

বস্তুত, ঝাড়খণ্ডে বিজেপি-র জয়ের চেয়ে বড় তাত্‌পর্যপূর্ণ ব্যাপার হল কংগ্রেসের আত্মঘাতী হার। জোট-রাজনীতির সুবাদে আগের বিধানসভা নির্বাচনেও যে দলটা চোদ্দোটি আসন পেয়েছিল, তা যে এ বারে অর্ধেকের বেশি কমে ছয়-এ নেমে থেমে গেল, শূন্যে পৌঁছল না, অনেকের কাছে সেটাও এক আশ্চর্যের ব্যাপার। গাঁধী পরিবারের যুবরাজের কল্পস্বর্গে বিহার অথবা অহংসর্বস্ব মূঢ় আত্মবিশ্বাসের তাড়নায় কংগ্রেস যে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে জোট ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল, তাতে জেএমএম-এর ক্ষতি হল ঠিকই, কয়েকটি নিশ্চিত আসন তাদের হারাতে হল, কিন্তু কংগ্রেসের পক্ষে তো ফলটা নিজের পায়ে কুড়ুল মারার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে দেখা দিল। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে জোটটা না ভাঙলে কংগ্রেস, জেএমএম এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মিলিত আসনসংখ্যা দাঁড়াত ৪০-এর কাছাকাছি, আর বিজেপি-র জোট নেমে যেত ৩০-এর আশেপাশে। এই বক্তব্যের বস্তুভিত্তি হচ্ছে সংখ্যা: ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবে গড়ে ওঠা জনমতের চাপ সত্ত্বেও জেএমএম ১৯টি আসন পেয়েছে, আগের বারের চেয়ে একটা বেশি। তা ছাড়া, অনেক আসনেই তারা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, ব্যবধান সামান্য, কংগ্রেস এবং আরজেডি-র ভোট যোগ হলে এই আসনগুলো তারা জিতত। কংগ্রেসও তথৈবচ, বেশ কয়েকটি আসন তারা ‘হেলায় হারাল’।

মুক্তি মোর্চার এই জয়টা অত্যন্ত তাত্‌পর্যপূর্ণ। দলটা শুধু ক্ষমতাসীন ছিল তা-ই নয়, এর নেতাদের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রচুর। এই নির্বাচনে দুর্নীতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে অনেক রথী-মহারথীর ভোটভাগ্য ভূলুণ্ঠিত। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারাণ্ডী, অর্জুন মুন্ডা ও মধু কোড়া, আজসু নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী সুদেশ মাহাত বিধানসভার প্রবেশপত্র পেলেন না, আগের সরকারের জেএমএম মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন বারহেট কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জিতে বিধায়ক হলেন বটে, কিন্তু দুমকাতে তাঁকেও হারতে হল। এক দিকে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে গড়ে তোলা ‘মোদী ঝড়’-এর প্রচার, অন্য দিকে দুর্নীতির অভিযোগ এবং জোট ভেঙে যাওয়া এত সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুক্তি মোর্চা কী ভাবে নিজের অস্তিত্ব ভাল ভাবেই টিকিয়ে রাখল?

এটা কি কেবল জনজাতীয় বা ঝাড়খণ্ডী ভাবাবেগের জোরে? সেটা নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার, কিন্তু জেতা আসনগুলোর চরিত্র ওটাকে একমাত্র ব্যাপার বলে চিহ্নিত করতে দেয় না। একমাত্রিক বিশ্লেষণে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা দলটির যে আদিবাসী-ভিত্তিক পরিচিতিটা দীর্ঘদিন ধরে লালিত হয়ে এসেছে, তার আড়ালে দলটির অন্য একটি চারিত্রিক মূল সম্পূর্ণ বিস্তৃত। সেই মূলটা হল ১৯৭০-এর দশকে দলটির গড়ে ওঠার সময় থেকেই তার শ্রেণিভিত্তিক লড়াই, ১৯৮০-র দশকে যা সুদখোর মহাজন-বিরোধী এবং জমির আন্দোলন রূপে ব্যাপক মাত্রা অর্জন করে। এ কথা ঠিক যে, দলটির এই সংগ্রামে প্রধান শক্তি ছিলেন আদিবাসীরাই। কিন্তু সেই আদিবাসীদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচিতির বাইরেও একটা পরিচয় ছিল যে, তাঁরা ভূমিহারা খেতমজুর। পরবর্তী কালে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার রূপান্তর ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু নৃগোষ্ঠীগত পরিচিতি ও অর্থনৈতিক শ্রেণির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ঝাড়খণ্ডী শ্রমজীবী গোষ্ঠীগুলোর কাছে সম্ভবত সেই আদি সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্মৃতিটা এখনও সজাগ এবং অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই লড়াইটা যে জরুরি, সেটা দুই ক্ষুদ্র বামপন্থী দল সিপিআই (এমএল) লিবারেশন এবং মার্ক্সবাদী কো-অর্ডিনেশন অর্গানাইজেশন-এর দুটো আসন জেতার মধ্য দিয়েও প্রতিষ্ঠিত।

ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীরা নিজভূমে পরবাসী, জনসংখ্যাতেও ক্রমশ প্রান্তিকতর হয়ে উঠছেন। এঁরাই এখানকার শ্রমজীবীদের সবচেয়ে বড় অংশ। আর বিজেপি-র প্রধান সমর্থনভিত্তি হচ্ছে আদিবাসীদের শোষণ ও বঞ্চনার সক্রিয় কারিগর, অ-আদিবাসী ধনবান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এ দ্বন্দ্বটিও সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সব থেকে নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষগুলো তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় যে রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন, সেখানে বিজেপি-র মধ্যে তাঁরা মিত্রতার কোনও লক্ষণ দেখেননি, এবং অনেক আশাভঙ্গ, অবিশ্বাস নিয়েও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার মধ্যেই তাঁরা শরণ নেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেয়েছেন, হয়তো একান্ত ভাবে বাধ্য হয়েই, বিকল্পের অভাবে। দুর্ভাগ্য, আদ্যন্ত শ্রেণিভিত্তিক একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে দেশের বামপন্থীরাও তেমন ভাবে চিনতে পারলেন না, এই ব্যাপক শ্রমজীবীদের কাছে নিজেদের গ্রহণীয় করে তোলার কোনও উদ্ভাবনী প্রয়াসও করলেন না, গোটা বিষয়টাকে পরিচিতি-ভিত্তিক একটা ব্যাপার বলে অস্পৃশ্য রেখে দিলেন।

রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আত্মোত্‌সর্গের সঞ্চিত পুঁজির সুদে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চালিয়ে যাওয়া যুবরাজ এটা বুঝবেন, এমনটা কেউ আশা করে না। কিন্তু শ্রেণি-রাজনীতির সংগ্রামী পরিচয়ে পরিচিতি বামপন্থীরা কি এখনও দ্বন্দ্বটা অনুধাবন করবেন না? বঞ্চিততম এই মানুষদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য কোনও উদ্ভাবনী রাজনীতির সন্ধান করবেন না? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, জনপরিসরের আলোচনায়, গণতান্ত্রিক চেতনা কি এখনও শব্দ বা নামমাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে থাকবে? যুক্তিসিদ্ধ বৈপরীত্যের ভাগিদার হবে না?

post editorial kumar rana
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy