Advertisement
E-Paper

যাহা আছে, তাহা আছে

যাহা ‘আছে’, তাহাকে ‘নাই’ ভাবিবার একটি সুবিধা আছে, জ্বলন্ত বাস্তবকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করার সুবিধা। এই অস্বীকৃতি যদি সরকারি নীতি-প্রণয়নকেও প্রভাবিত করে, তবে তাহার শিকার হন জনসাধারণ। ভারতীয়, বিশেষত হিন্দু সমাজের জাতিভেদপ্রথা এমন এক বাস্তব। এই সমাজে যেমন উচ্চবর্ণীয় বিভিন্ন জাত রহিয়াছে, তেমনই আছে নিম্ন বর্ণের অন্তর্ভুক্ত অনেক জনগোষ্ঠীও।

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

যাহা ‘আছে’, তাহাকে ‘নাই’ ভাবিবার একটি সুবিধা আছে, জ্বলন্ত বাস্তবকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করার সুবিধা। এই অস্বীকৃতি যদি সরকারি নীতি-প্রণয়নকেও প্রভাবিত করে, তবে তাহার শিকার হন জনসাধারণ। ভারতীয়, বিশেষত হিন্দু সমাজের জাতিভেদপ্রথা এমন এক বাস্তব। এই সমাজে যেমন উচ্চবর্ণীয় বিভিন্ন জাত রহিয়াছে, তেমনই আছে নিম্ন বর্ণের অন্তর্ভুক্ত অনেক জনগোষ্ঠীও। তদুপরি এই দুই প্রান্তের অন্তর্বর্তী বেশ কিছু জনগোষ্ঠীও রহিয়াছে, যাহারা অনগ্রসর বলিয়া পরিচিত। দেশে কিংবা রাজ্যে রাজ্যে এই সব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বা শতাংশের হার কত, তাহা নির্ণয় করা সম্ভব জনগণনা মারফত। দশ বৎসর অন্তর এই গণনা দেশের জনবিন্যাসের কাঠামো এবং সেই কাঠামোয় সম্ভাব্য রদবদলের জরুরি হদিশ দিয়া থাকে, যাহার ভিত্তিতে সরকার সমাজের পশ্চাৎপদ বর্গগুলির জন্য রকমারি উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু ১৯৩১ সালের পর হইতে অনগ্রসর শ্রেণিগুলির পরিসংখ্যান জনগণনায় সংগ্রহ করা হয় না, কেবল তফসিলি জাতি ও জনজাতির হদিশ মেলে। মাদ্রাজ হাইকোর্ট কয়েক বছর আগে জনগণনা কর্তৃপক্ষকে অনগ্রসর শ্রেণিগুলির বিন্যাসও নিরূপণ করিতে বলিয়াছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই অনুজ্ঞা রদ করিয়া দিয়াছে।

সর্বোচ্চ আদালত যুক্তি দিয়াছে, সরকারি নীতি প্রণয়নে বিচারবিভাগের অহেতুক হস্তক্ষেপ অনুচিত, সুতরাং হাইকোর্টের নির্দেশটি ঠিক ছিল না। এই যুক্তি শিরোধার্য। গুরুত্বপূর্ণও বটে। কিন্তু তাহার পরেও প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রশ্নটি আদালতের নিকট নহে, সরকারের নিকট। জনগণনায় জাতপাতের হিসাব কেন লওয়া হইবে না? অনগ্রসর শ্রেণিগুলি কি ভারতীয় সমাজে বিরাজ করে না? তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের মতো তাহাদেরও কি স্বতন্ত্র বর্গ রূপে গণ্য করা হয় না? পরাশর-মনুর কাল হইতে যে সামাজিক ভেদাভেদ ভারতকে জর্জরিত করিয়া আসিতেছে, তাহার তথ্যপূর্ণ হিসাব লইতে অসুবিধা কী? সত্য, এমন হিসাব না-লইতে হইলেই ভাল হইত। ভাল হইত, যদি ভারতীয় সমাজে বর্ণভেদ প্রথাই না থাকিত, যদি জীবিকার ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ধারণের বর্বরতাই না থাকিত। কিন্তু ভারতীয় সমাজের বাস্তবতাটি তেমন আদর্শ কিছু নয়। এখানে বর্ণভিত্তিক বিভাজন ও বঞ্চনার কারণেই সামাজিক ন্যায়ের প্রতিকার প্রকল্পিত হইয়াছে। শুরুতে কেবল তফসিলি জাতি-জনজাতিদেরই সেই বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হিসাবে শনাক্ত করিয়া তাহাদের জন্য শিক্ষা ও চাকুরিতে সংরক্ষণের সাংবিধানিক বন্দোবস্ত হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে দেখা যায়, উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের মাঝামাঝি অবস্থানকারী অনগ্রসর শ্রেণিগুলিও কম অবিচারের শিকার নয়। ফলে সংরক্ষণ নীতির পর্যালোচনা ও সংশোধনও আবশ্যিক হইয়া পড়ে।

মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ জাতীয় জীবনে যে অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়, তাহার পর আর সমাজের এই বর্গ-বিভাজনের দিকে চোখ বুজিয়া থাকা সম্ভব ছিল না। মাদ্রাজ হাইকোর্ট তাই জনগণনা কর্তৃপক্ষকে অনগ্রসর শ্রেণিগুলির গণনা আদমসুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করিতে বলিয়া ইতিহাস ও সমসাময়িক বাস্তবতাকেই স্বীকার করিয়াছিল। তাহার হস্তক্ষেপ অনধিকার চর্চা হইতে পারে, কিন্তু তাহার উদ্দেশ্যটি প্রণিধানযোগ্য। সরকারের নিজেরই নীতি পরিবর্তন করা উচিত। এই ধরনের গণনায় জনবিন্যাসের যে কাঠামো উন্মোচিত হয়, তাহা সরকারকে সাহায্যই করিবে। বিভিন্ন অনগ্রসর বর্গের জনসংখ্যার হিসাব সামনে থাকিলে তাহার চাহিদা পূরণ ও উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ এবং বরাদ্দ নির্ধারণেও সাহায্য হইবে। সংরক্ষণই সামাজিক ন্যায় মিলাইবার শ্রেষ্ঠ পন্থা কি না, সে বিতর্ক এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বহুধাবিভক্ত সমাজের প্রকৃত চিত্রটি স্পষ্ট জানা দরকার।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy