কী করিতে হইবে, তাহা জানিবার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের ইচ্ছাময়ী সর্বাধিনায়িকা এবং তাঁহার পারিষদদের লেনিনের রচনাবলি পাঠ করিবার কোনও প্রয়োজন নাই, তাঁহাদের আপন দলের এক সাংসদের আচরণ অনুসরণ করিলেই চলিবে। তাঁহার নাম সুগত বসু। সারদা কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র হইতে নির্বাচিত এই ইতিহাসবিদ সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন, আর্থিক নয়ছয়ে যুক্ত যে কোনও ব্যক্তির শাস্তি হওয়া উচিত, তিনি যে পদের অধিকারীই হউন, এবং এ বিষয়ে আদালতের উপর তাঁহার আস্থা আছে। এ যাবত্ তিনি এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেন নাই। তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা ইহাই যে, এ যাবত্ সারদা কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে তাঁহার দলের বিচিত্র হইতে বিচিত্রতর ‘আন্দোলন’-এ তাঁহাকে একটি বারের জন্যও দেখা যায় নাই। সংসদের সামনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা যখন কোনও দিন কালো চাদর, কোনও দিন কালো হাঁড়ি, কোনও দিন বা লাল ডায়েরি লইয়া লজ্জাকর কুনাটক জমাইয়াছেন, তখনও তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এই বিষয়েও তাঁহার বক্তব্য প্রাঞ্জল: তিনি সংসদে গঠনমূলক কাজ করিতেছিলেন (এবং তাঁহার অত্যন্ত অর্থপূর্ণ সংযোজন: ‘সকলের দ্বারা তো সব কাজ হয় না’)। দুই আর দুইয়ে তিনও হয় না, পাঁচও নহে, সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্যই বুঝিতেছেন, সুগতবাবু তাঁহার নির্দেশিত প্রতিবাদ-নাটিকার কঠোর সমালোচক। তিনি যে নীতিসম্মত এবং যথাযথ অবস্থান লইয়াছেন, প্রথম হইতে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সহকর্মীদের সেই অবস্থানই গ্রহণ করা বিধেয় ছিল, একটি এবং একটিমাত্র বাক্য উচ্চারণ করা উচিত ছিল: আইন আইনের পথে চলিবে। পরিবর্তে তাঁহারা ‘রাম চোর? শ্যাম চোর? যদু চোর?’ হুঙ্কার ছাড়িয়া পাড়া মাথায় করিয়া চলিয়াছেন!
সুগতবাবুর ‘সকলের দ্বারা তো সব কাজ হয় না’ বাক্যটির সূত্র ধরিয়াই পুরজনে একটি কূটপ্রশ্ন তুলিতে পারেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ এবং বিধায়কদের মধ্যে, খুব বেশি না হউক, অন্তত কয়েক জন আছেন যাঁহাদের শিক্ষাদীক্ষা কম নহে, বিদ্যাবুদ্ধির স্বীকৃতি আছে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করিবার, এমনকী নেতৃত্ব দিবার অভিজ্ঞতা আছে। মর্যাদার মাপকাঠিতে তাঁহারা সমাজের উচ্চকোটির মানুষ। সংসদীয় গণতন্ত্রে হাঁড়ি বাজানো অপেক্ষা অনেক জরুরি কাজ আছে, তাহা সকলে উপলব্ধি করুন বা না করুন, এই ধরনের রাজনীতিকদের অন্তত বুঝিবার কথা। অথচ দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ডেরেক ও’ব্রায়েন, সৌগত রায়দেরও কুনাট্যরঙ্গে মাতিতে দেখা যাইতেছে। ‘নেত্রী বলিয়াছেন, তাই কালো চাদর গায়ে লাল ডায়েরি হাতে ধর্না দিতেছি’ বলিয়া তাঁহারা ভাবের ঘরে চুরি করিতে পারেন, সদুত্তর অন্য বস্তু। নেতা, নেত্রী বা দলের অন্যায় আদেশ পালন করা সাংসদ বা বিধায়কদের কাজ হইতে পারে না, শেষ বিচারে তাঁহাদের দায়বদ্ধতা নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে, যাঁহারা তাঁহাদের ভোট দিয়া আইনসভায় পাঠাইয়াছেন। তাঁহাদের কাজ সেই সভায় নিষ্ঠার সহিত কাজ করা, আইন-প্রস্তাব তৈয়ারিতে জড়িত থাকা, আইনসভার বিতর্কে যোগ দেওয়া, যে বিতর্কের একটিই লক্ষ্য: জনসাধারণের স্বার্থরক্ষা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁহাদের বাছিয়া বাছিয়া ভোটপ্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই আপন ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করিবেন, এমন আশা বাতুলতামাত্র। কিন্তু যে কয় জনের শিক্ষাগত এবং অভিজ্ঞতাপ্রসূত যোগ্যতা আছে, তাঁহারা অন্তত সুগত বসুর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ এতটা পুড়িত না। তাঁহাদের নিজেদেরও মানরক্ষা হইত। অবশ্য তাঁহাদের মস্তিষ্ক হয়তো বেশ ভাল করিয়া শিখিয়া লইয়াছে: যায় যদি যাক মান, আমাদের দিদি ভগবান।