নরেন্দ্র মোদীর প্রচারমন্ত্র ছিল: ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক প্রশাসন। প্রশাসন অধিক হইবে না অল্প, তাহা ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু মন্ত্রিসভা যদি সরকারের আয়তনের মাপকাঠি হয়, তবে বলিতে হইবে, নূতন প্রধানমন্ত্রী ‘ন্যূনতম’ শব্দটির অর্থ নূতন করিয়া লিখিতে চাহেন। সত্য, দ্বিতীয় ইউপিএ মন্ত্রিসভার একাত্তর হইতে মোদী সরকারের চুয়াল্লিশ প্রায় চল্লিশ শতাংশ কম। কিন্তু প্রথমত, অদূর ভবিষ্যতে মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িবেই। দ্বিতীয়ত, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বলীয়ান নরেন্দ্র মোদী শেষ পর্যন্ত জোটনির্ভর এবং বিবিধ দুর্বলতায় আক্রান্ত মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভার সহিত আয়তনের তুলনা করিবেন, এমন কথা তো ছিল না! বস্তুত, জোটনির্ভর অটলবিহারী যে মাপের সরকার চালাইয়াছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মোদী সরকার অচিরেই তাহার কাছাকাছি পৌঁছাইয়া যাইবে। ইহা, আর যাহাই হউক, বলিষ্ঠ এবং সাহসী সংস্কারের পরিচায়ক নহে। নরেন্দ্র মোদী সংস্কার শুরু করিবার বিরাট সুযোগ পাইয়াছিলেন। যে বলে ছয় রান করিবার, তাহাতে তিনি এক, বড়জোর দুই রান সংগ্রহ করিলেন।
মন্ত্রীর সংখ্যা একটি মাপকাঠি, একমাত্র নহে। মূল প্রশ্ন, মন্ত্রিসভার কাঠামো কেমন হইবে? ভারতে বহু অপ্রয়োজনীয় মন্ত্রকের সৃষ্টি হইয়াছে, যেখানে একটি মন্ত্রক যথেষ্ট সেখানে একাধিক মন্ত্রক বসানো হইয়াছে। আশা ছিল, নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার কাঠামোটিকে সম্পূর্ণ নূতন করিয়া বিচার করিবেন, অবান্তর মন্ত্রকগুলি ছাঁটাই করিবেন, বিবিধ মন্ত্রককে সংহত করিয়া মন্ত্রকের সংখ্যা কমাইবেন। কিন্তু কার্যত তাহার কিছুই হয় নাই। ‘ইস্পাত ও খনি’ একত্র হইবার একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, হয়তো বিদ্যুৎ এবং কয়লা সমবেত হইবে, কিন্তু সেগুলি বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ। ‘ন্যূনতম সরকার’ কেন রেল সহ সমস্ত পরিবহণকে একত্র করিতে পারিল না, কেন ভারী শিল্প, রাসায়নিক ও সার কিংবা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি বিবিধ শিল্পের জন্য বিবিধ মন্ত্রক থাকিয়া গেল? বস্তুত, বড় আকারের নীতি নির্ধারণের প্রশ্ন না থাকিলে মন্ত্রকের কোনও প্রয়োজনই নাই। এই যুক্তিতে সার, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অসামরিক বিমান পরিবহণ ইত্যাদি বহু মন্ত্রক সম্পূর্ণ তুলিয়া দেওয়াই বিধেয়। পরবর্তী পর্যায়ে এমনকী শিল্প মন্ত্রককেও বিদায় জানানো দরকার। শিল্পের উন্নয়ন বাজারেই স্থির হইবার কথা, দুনিয়ার বহু উন্নত দেশেই শিল্প মন্ত্রক নাই।
কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্নগুলি লইয়া ভাবিবার চেষ্টা নরেন্দ্র মোদী করিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। ঠিক যেমন, রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের মালিকানা এবং পরিচালনার প্রশ্নটিকে স্বতন্ত্র করিবার প্রাথমিক চেষ্টাও অ-দৃশ্য। ইস্পাত বা অসামরিক বিমান পরিবহণের মতো নানা ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানায় এখনও বিপুল সম্পদ, তাহার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রক থাকিতে পারে। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তাহার কোনও ভূমিকা থাকিবে না, সেখানে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বাজারের নিয়ম মানিয়া চলিবে। এই নীতি মানিলে স্বতন্ত্র মন্ত্রকের কোনও অর্থই অবশিষ্ট থাকে না বেসরকারি ইস্পাত কারখানা এবং সরকারি ইস্পাত কারখানা, উভয়েই বাজারের নির্দেশে চালিত হওয়া উচিত, মন্ত্রীর কী প্রয়োজন? কিন্তু এই ধরনের সংস্কারের জন্য বাঁধা গত ছাড়িতে হয়। তেমনই, মন্ত্রিসভায় বাহির হইতে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানাইবার জন্যও গতানুগতিকতার ধারা বর্জন করিতে হয়। নরেন্দ্র মোদী তাহাতেও ব্যর্থ, অন্তত প্রথম পর্বে। তিনি লোকসভার, এমনকী সংসদের বাহির হইতে কয়েক জনকে মন্ত্রিসভায় আনিয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা সবাই রাজনীতিক। এই একটি বিষয়ে অন্তত তিনি তাঁহার প্রতিপক্ষের এক নায়কের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে পারিতেন, তাঁহার নাম নরসিংহ রাও।