Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

শিশুশ্রম: গুজরাতের চেয়ে ভাল, এই যা

শিশু কর্মীদের বঞ্চনার উপর নির্মিত অনৈতিকতার সৌধ দেশের নৈতিক ভিতটাকে দুর্বল করে। এই খণ্ডিত নৈতিকতার জৌলুস নিয়ে চাঁদ ধরার আস্ফালন চলে, চাঁদ অধরাই থাকে।ছোটু চায় লে আও’! শিশুর অধিকার নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা, অতএব চা চাই, অতএব ছোটু! কোনও কোনও শিশু অধিকারবিদ অবশ্য প্রতীকী প্রতিবাদে ছোটুদের আনা চা খান না, যদিও তাঁদের অনেকের বাড়িতেই ‘ছুটকি’দের ছাড়া সংসার চলে না। ছোটুদের মতোই দেশে অসংখ্য ছুটকিও শৈশব হারিয়ে রোজগারের পথে নামতে বাধ্য হয়, প্রায় মায়ের কোল-ছাড়া হওয়ার মুহূর্তেই।

পিয়ালী পাল
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ০০:২৭
Share: Save:

ছোটু চায় লে আও’! শিশুর অধিকার নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা, অতএব চা চাই, অতএব ছোটু! কোনও কোনও শিশু অধিকারবিদ অবশ্য প্রতীকী প্রতিবাদে ছোটুদের আনা চা খান না, যদিও তাঁদের অনেকের বাড়িতেই ‘ছুটকি’দের ছাড়া সংসার চলে না। ছোটুদের মতোই দেশে অসংখ্য ছুটকিও শৈশব হারিয়ে রোজগারের পথে নামতে বাধ্য হয়, প্রায় মায়ের কোল-ছাড়া হওয়ার মুহূর্তেই। ২০১১-র জনগণনা আমাদের জানাচ্ছে, সারা দেশে ৪,৩০,৭৮৫ এমন ‘কর্মী’ আছে, যাদের বয়স, চমকে উঠবেন না, মাত্র পাঁচ বছর! এবং মনে রাখা ভাল, জনগণনার সংজ্ঞা অনুযায়ী কর্মী তাঁরাই, যাঁরা অর্থকরী উপার্জনের সঙ্গে পূর্ণ সময় যুক্ত: বছরে ১৮৩ দিন বা তার বেশি কাজ করলে মুখ্য কর্মী, তার কম হলে প্রান্তিক কর্মী।

শিশু অধিকার নিয়ে কত আইন, কত বাগ্বাজি, কুম্ভীরাশ্রুর বন্যা, অথচ সারা দেশে এখনও মোট কর্মীর প্রতি কুড়ি জনের মধ্যে এক জন হচ্ছে ৫-১৭ বছর বয়সি শিশু, সংখ্যাটা প্রায় আড়াই কোটি। এদের মধ্যে প্রায় এক কোটিই হচ্ছে ছুটকিরা। মোট শিশু কর্মীর নিরিখে মেয়েদের সংখ্যাটা কম মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু মোট নারী কর্মীর মধ্যে এদের অনুপাত (৬.৩ শতাংশ) পুরুষদের অনুপাত (৪.৩ শতাংশ)-এর চেয়ে বেশি।

এ তো গেল মোটের হিসেব। যতই সামাজিক বিভাজনের সিঁড়ি ধরে নীচে নামা হবে, ততই দেখা যাবে অবস্থাটা ভয়াবহতর: দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে শিশু কর্মীর অনুপাত যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে নারী কর্মীদের মধ্যে শিশুদের অনুপাত। আদিবাসীদের মধ্যে অবস্থাটা কতটা খারাপ, সেটা অন্য একটা অংক থেকে পরিষ্কার। মোট শিশু কর্মীর ১৭ শতাংশই আদিবাসী, যদিও জনসংখ্যায় তারা মাত্র ৯ শতাংশ।

সর্বশিক্ষা অভিযান এক দশক অতিক্রান্ত, শিক্ষার অধিকার আইনের বয়সও অর্ধদশক, শিশুরা ইস্কুলে আসছে এমন আনন্দঘন সংবাদে দেশের আহ্লাদ ধরে না। কিন্তু এই কয়েক কোটি শিশুর কী হবে, যারা বাস্তবিকপক্ষে সংসার টানে? বয়সের হিসেবে দেখা যাচ্ছে মোট শিশু কর্মীদের মধ্যে শতকরা ১১ জনেরই প্রাথমিক স্তরে পড়ার কথা, আর ৩২ শতাংশের পড়ার কথা উচ্চ প্রাথমিক স্তরে। এই ৪৩ শতাংশ (সংখ্যায় কোটিখানেক) হচ্ছে শিক্ষার অধিকার আইনের আওতায়। আইনের চোখে সকলে সমান, কিন্তু আইন সবার জন্য কতটা সমান? শিশুশ্রমও তো আইনত নিষিদ্ধ, কিন্তু সে আইনই বা সকল শিশুর জন্য কতটা সমদর্শী?

শিশু শ্রমিক বলতে সাধারণত ছোটু-ছুটকিদের কথাই লোকে বুঝে থাকে, কিন্তু বাস্তবত আইন, সুভদ্র সমাজ, উন্নয়নের জয়ধ্বজার অন্তরালে যে শিশুরা ‘দেহশ্রম’ বিক্রি করে চলেছে, তারা ছড়িয়ে আছে নানান ক্ষেত্রে, বেশির ভাগই কৃষিকর্মে: চাষবাসে শতকরা ২৩ ভাগ এবং খেতমজুরিতে ৩৮ ভাগ। শিশুশ্রম বিষয়ক আলোচনায় এই কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্তদের কথাটা যে আসেই না, তার কারণ বোধহয় এই শিশুদের সামাজিক অবস্থান, যারা প্রধানত দলিত বা আদিবাসী, উন্নয়নের নানান সূচক অনুযায়ী যে গোষ্ঠীগুলো সুযোগবঞ্চনার জীবন্ত নমুনা। অথচ পথ যে একেবারেই নেই, তা নয়। আমরা যদি শূন্যকুম্ভ নৈতিকতা এবং শুষ্ক সংবেদনশীলতা থেকে বেরিয়ে সহজ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান-নির্ভর যুক্তিকে অবলম্বন করি, তা হলে যে পথ একটা পাওয়া যায়, তার ইঙ্গিতও জনগণনার হিসেব থেকে স্পষ্ট। যেখানে সারা দেশে মোট কর্মীর ৫ শতাংশ হচ্ছে শিশু, সেখানে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, কেরল, তামিলনাড়ু ও ত্রিপুরাতে সংখ্যাটা অনেক কম: যথাক্রমে ০.৯, ২.৪ ও ২.৯ শতাংশ। সাফল্যের কারণটির পিছনে ব্যাখ্যা একটাই: রাজ্যগুলো ইট-সিমেন্ট-কংক্রিট-নির্ভর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দেবতার পদতলে নিজেদের সঁপে না দিয়ে একেবারে গোড়ার কাজটাতে মনোনিবেশ করেছে। এ কাজট হল মানব সক্ষমতার বৃদ্ধির ভিতর দিয়ে সমাজে সকল মানুষের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তার একটা ভিত্তি গড়ে তোলা। শিশু পুষ্টি, শিশু স্বাস্থ্য, শিশু শিক্ষার মতো বিষয়গুলিতে এই সব রাজ্য যে প্রাধান্য অর্পণ করেছে, তার সুফল হিসেবেই সেখানে হৃতশৈশব শিশুদের সংখ্যাটাকে কমিয়ে আনা গেছে। বিপরীতে, উন্নয়নের যে গুজরাত মডেল অনুসরণ করে দেশকে বিশ্ব অর্থনীতির মহারথীদের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলার স্বপ্ন বিক্রি করা হচ্ছে, সেখানে মোট কর্মীর মধ্যে শিশু কর্মীর অনুপাত ৫.২ শতাংশ, সংখ্যায় তেরো লক্ষের বেশি। হিন্দি বলয়ের রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, সর্বত্র সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের ভয়াবহ অনুন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিশু কর্মীর অনুপাত ৬ শতাংশের উপরে।

পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ে জানতে কৌতূহল হচ্ছে? তা হলে বলি, অর্থনীতি এবং সমাজের অধিকাংশ বিষয়ে যে মধ্যমান আঁকড়ে ধরে থাকার দূর প্রতিজ্ঞায় এ রাজ্য অনড় এবং যার ফলে উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই দেশের মধ্যে তার স্থান মোটামুটি মাঝামাঝি, শিশু কর্মীর অনুপাতের দিক দিয়েও সেই অচলায়তনের ব্যত্যয় ঘটেনি: অনুপাতটি ৪.৫%, গুজরাত বা হিন্দি বলয়ের থেকে অবশ্যই ভাল, কিন্তু কেরল, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা থেকে অনেকটাই খারাপ।

শিশু কর্মীদের এই কাহিনিটি কেবল শিশুদের বঞ্চনাতেই শেষ হয়ে যায় না, এই শিশুরাই বড় হয় ঊনমানবের মতো। তারা যা হতে পারত এবং তা হয়ে ওঠার জন্য যা করতে পারত, সেই সক্ষমতার অভাবটাই প্রভাব ফেলে, শুধু তাদেরই জীবনে নয়, গোটা দেশের উৎপাদনশীলতায়। তার চেয়েও বড় কথা, তাদের প্রতি ওই যে দৃষ্টিভঙ্গি, অবহেলা ও বঞ্চনার উপর নির্ভর করে অনৈতিকতার যে সৌধ নির্মাণ, তা তো আসলে গোটা দেশের নৈতিক ভিতটাকেই দুর্বল করে রাখে। এই খণ্ডিত নৈতিকতার জৌলুস নিয়ে চাঁদ ধরার আস্ফালন চলে, কিন্তু চাঁদ অধরাই থেকে যায়। ছোটু ও ছুটকি-রাও যে ভারতবর্ষেরই অংশবিশেষ, এই তথ্য-বিস্ফোরণ সেই দেশটাকেই ছোট করে। সেই বোধ কবে আসবে?

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

piyali pal anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE