লালমোহনবাবু অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে জানিতে চাহিয়াছিলেন, উট বিষয়ক প্রশ্ন চলিতে পারে কি? প্রদোষচন্দ্র মিত্রের তুলনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অধিকতর ভীতিপ্রদ, কোনও সন্দেহ নাই। তবু, সাবিত্রী মিত্ররা এক বার জিজ্ঞাসা করিতে পারিতেন, মন্ত্রিত্ব বিষয়ক প্রশ্ন চলিবে? প্রশ্নটি এই রূপ— লোকসভা নির্বাচনে দলের ভাল ফল নিশ্চিত করা কোন দফতরের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত, সমাজকল্যাণ না কি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ? মুখ্যমন্ত্রী কী বলিবেন, তিনিই জানেন। তবে কাণ্ডজ্ঞান বলিবে, কোনও দফতরেরই নহে। তবে কেন নির্বাচনী ফল নেত্রীর মনঃপূত না হওয়ায় সাবিত্রী মিত্র এবং সুব্রত সাহার এই দুই মন্ত্রক হইতে মন্ত্রিত্বের চাকুরি গেল? বিশেষত, তাঁহাদের সরাইয়া দেওয়ার পরের দিনই যখন টাউন হলে মূল্যায়নের প্রহসনটি ছিল, তখন এই দুই মন্ত্রী তাঁহাদের দফতর চালাইতে কতখানি ব্যর্থ, তাহা খতাইয়া দেখিবার পর বরখাস্ত করিলে কিঞ্চিৎ শোভন হইত না? সম্ভবত আরও একটি দিন রাগ চাপিয়া রাখা দলনেত্রীর অসাধ্য হইয়াছিল। কাজেই, তাঁহাদের ‘শাস্তি’ হইল।
তবে, ইতিহাস সম্বন্ধে খানিক সচেতন হইলে মুখ্যমন্ত্রী দ্বিধায় পড়িতেন— তিনি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেছেন, তাহা শাস্তি, নাকি পুরস্কার? পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সাবিত্রী মিত্রদের পূর্বে কোনও দফতরহীন মন্ত্রী নাই। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে বিলক্ষণ আছেন। তাঁহার নাম লালবাহাদুর শাস্ত্রী। জওহরলাল নেহরু যখন তাঁহাকে দ্বিতীয় দফায় নিজের মন্ত্রিসভায় ফিরাইয়া আনেন, তাঁহাকে বিশেষ কোনও দফতরের ভার দেন নাই। তিনি ছিলেন দফতরহীন মন্ত্রী। কিন্তু, মন্ত্রিসভায় তাঁহার গুরুত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রীর পরেই। বস্তুত, শারীরিক ভাবে ক্রমে অশক্ত হইয়া পড়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব যাহাতে তিনি অনেকখানি বহন করিতে পারেন, সেই কারণেই তাঁহাকে দফতরহীন রাখা হইয়াছিল। আর পাঁচটি প্রশাসনিক অভ্যাসের ন্যায় দফতরহীন মন্ত্রীও ইংল্যান্ডের নীতি হইতেই ভারতে আসিয়াছিল। সে দেশের আইনসভায় দফতরহীন মন্ত্রী ব্যতিক্রম নহেন, কার্যত নিয়ম। গত শতকের ত্রিশের দশকে অ্যান্টনি ইডেনও দফতরহীন মন্ত্রী ছিলেন। বস্তুত, পার্টির চেয়ারম্যানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যাহাতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত থাকিতে পারেন, অথচ কোনও দফতরের দৈনন্দিন কাজে যাহাতে তাঁহাদের জড়াইয়া পড়িতে না হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে তাঁহাদের দফতরহীন মন্ত্রীর পদ দেওয়া হইত। এখনও কেনেথ ক্লার্ক বা গ্রান্ট শাপ্স-এর ন্যায় রাজনীতিকরা ডেভিড ক্যামেরনের সরকারে দফতরহীন মন্ত্রী রূপে আছেন। কাজেই, ইতিহাস-অজ্ঞ হইয়া মুখ্যমন্ত্রী যাহাকে শাস্তি ভাবিলেন, তাহা কত বড় পুরস্কার, ভাবিয়া দেখিলে অমিত মিত্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা দুঃখিত হইতে পারেন।
দফতরহীন মন্ত্রীরা এক দিকে নিজ পরিচয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর অন্য দিকে তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর (বা প্রধানমন্ত্রীর) প্রায় সমগোত্রীয়। সরকারের প্রধানের স্কন্ধে যে কাজের ভার, তাহা লাঘব করাই এই মন্ত্রীদের মুখ্য কর্তব্য। সাবিত্রী মিত্ররাও আপাতত দফতরহীন আর মুখ্যমন্ত্রীর স্কন্ধে বোঝাবিশেষ। তাঁহারাও সেই বোঝার কিয়দংশ বহন করিতে পারেন বইকী। শাস্তির মোড়কে এমন পদোন্নতির নজির খুব একটা নাই। মুখ্যমন্ত্রীও সম্ভবত বুঝিয়াছেন, রাজ্যের সব সমস্যা একা হাতে মিটাইয়া দেওয়ার সাধ্য তাঁহারও নাই। কয়েক জন দফতরহীন মন্ত্রী চাই। তবে, দলের অন্য নেতারা গোঁসা করিতে পারেন। রাজ্যের বেশির ভাগ কেন্দ্রেই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা জয়ী হইয়াছেন। দুর্জনে বলিতেছে, সব জয় মানুষের রায়ের প্রতিফলন নহে। কাজেই, মানুষকে বুঝাইয়াই হউক বা অন্য পথে, যে নেতারা দলের জয় নিশ্চিত করিলেন, তাঁহারা দুঃখ পাইলে অস্বাভাবিক নহে— কঠিন পরিশ্রমের কী প্রতিদান তাঁহারা পাইলেন! পরের বার তাঁহারাও পদোন্নতির, মতভেদে শাস্তির, প্রত্যাশায় থাকিলে দোষ দেওয়ার উপায় থাকিবে না।