Advertisement
E-Paper

স্কুলে কল থেকে জল পড়ে!

স্বাধীনতার সাতষট্টি বছর পরে গ্রামের স্কুলে শৌচাগারে জল এল। তা-ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সরকার কী করছে? রাজনৈতিক দল? চোপ, এখন নির্বাচন চলছে। লিখছেন জয়ন্ত বসু।দেবীপুর করুণাময়ী বালিকা বিদ্যায়তন। কলকাতা থেকে মাত্র পঁচাশি কিলোমিটার দূরে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুলতলি ব্লকের একটি মেয়েদের স্কুল। প্রায় ছ’শোর ওপর ছাত্রী। এমনকী চৌত্রিশ জন আদিবাসী ছাত্রী স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন অবধি স্কুলের ফলও খারাপ নয়। তো, এই স্কুলে গত ২৭ মার্চ সাজ সাজ রব। স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝের চত্বরে বড় প্যান্ডেল।

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৫৫
কার কার বাড়িতে মোবাইল আছে? দেবীপুরের স্কুলে। ছবি: লেখক।

কার কার বাড়িতে মোবাইল আছে? দেবীপুরের স্কুলে। ছবি: লেখক।

দেবীপুর করুণাময়ী বালিকা বিদ্যায়তন। কলকাতা থেকে মাত্র পঁচাশি কিলোমিটার দূরে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুলতলি ব্লকের একটি মেয়েদের স্কুল। প্রায় ছ’শোর ওপর ছাত্রী। এমনকী চৌত্রিশ জন আদিবাসী ছাত্রী স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন অবধি স্কুলের ফলও খারাপ নয়। তো, এই স্কুলে গত ২৭ মার্চ সাজ সাজ রব। স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝের চত্বরে বড় প্যান্ডেল। মঞ্চে মাইক, ফুল, সামনে সারি সারি চেয়ার, পাশে রান্নাবান্নার আয়োজন। দিনটা ঐতিহাসিক, কারণ সে দিন স্কুলের শৌচাগারে কল থেকে প্রথম জল পড়ল। স্বাধীনতার সাতষট্টি বছর পরে।

হয়তো আরও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হত, যদি না সৌরবিজ্ঞানী শান্তিপদ গণচৌধুরী একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করতেন, যেটি সৌরশক্তি সরবরাহ করে, যে শক্তির সাহায্যে পাম্প চালিয়ে পাশের পুকুর থেকে জল ছাদের ট্যাঙ্ক ঘুরিয়ে শৌচালয়ের কলে পৌঁছে দেওয়া হয়, তার পরে আবার ফিল্টার ব্যবহার করে জল পরিস্রুত করা হয়। বাড়তি সৌরশক্তি দিয়ে স্কুলে কয়েকটা আলোও জ্বলছে। বলে রাখা ভাল, ওই অঞ্চলে দশ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুত্‌ আসেনি।

শান্তিপদবাবুই জানালেন, সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে কমপক্ষে এমন একশো কুড়িটা স্কুল আছে, যেখানে শৌচাগারে যেতে হলে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের কাছের পুকুর থেকে বালতি করে জল তুলে নিয়ে যেতে হয়। অনেক স্কুলে আবার খুব কাছাকাছি পুকুরও নেই। আর, পানীয় জলের ঠিকানা কোনও একটা টিউবওয়েল, যা হয়তো মাঝে মাঝেই খারাপ থাকে। এই অবস্থার প্রভাব পড়ছে মেয়েদের শিক্ষার ওপরে। শৌচাগারে জল না থাকার ফলে ড্রপআউট বাড়ছে। ক্লাস সেভেন বা এইটে ছাত্রীসংখ্যা একশো ত্রিশের ওপর হলেও ক্লাসে টেনে পৌঁছে তা অর্ধেকেরও নীচে নেমে যায়। নতুন ব্যবস্থা কেমন চলছে? টেলিফোনের ও পারে শিক্ষিকার উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর, ‘ভাবতে পারবেন না, ছাত্রীরা লাইন দিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে, খাবার জল নিচ্ছে। আসলে স্কুলের কল থেকে জল পড়ে, এমনটা তো ওরা কখনও দেখেনি।’

অথচ অঞ্চল, রাজ্য, দেশ জুড়ে যাবতীয় রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারে স্কুলের শৌচাগারে জল থাকা বা পরিস্রুত পানীয় জল পাওয়ার মতো বিষয়গুলি কখনওই বড় কথা হয়ে ওঠে না। বস্তুত, নির্বাচনী ইস্তাহারগুলিতেও এ সব বিষয়ের উল্লেখ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।, থাকলেও প্রায় স্কুলের রচনা লেখার স্টাইলে। ২০১৪ সালে দাঁড়িয়ে, রাজ্যে তিন দশকের ওপর ক্ষমতায় থাকার পরে, সি পি এম যদি পানীয় জল, শৌচব্যবস্থা, বিদ্যুতের মতো ‘প্রাথমিক পরিষেবা’গুলি দেওয়ার গতে বাঁধা অঙ্গীকার করে, তবে তিন বছর সরকারে থাকা তৃণমূল কংগ্রেস ‘বাস্তবমুখী জনমুখী পরিবেশ আইন’ করার কথা বলছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই দাবিও করেছে যে, সাধারণ স্কুলের ৯২ শতাংশে ও বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলের ৮২ শতাংশে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু গুনতির আড়ালে গুণমান? এই সব শৌচাগারের কত শতাংশ ব্যবহারের অযোগ্য, সেই হিসেব?

এমন নয় যে, দেবীপুরের মতো অঞ্চলে কিছুই পৌঁছয়নি। হ্যঁা, পৌঁছেছে। সেগুলিই পৌঁছেছে যেগুলির জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার দরকার হয় না, বাজার তার নিজের নিয়মেই পৌঁছে দেয়। যেমন মোবাইল ফোন। ‘কার কার বাড়িতে মোবাইল ফোন আছে?’ এ প্রশ্নে দেবীপুরের স্কুলটিতে কয়েকশো ছাত্রীর প্রায় সকলের হাত ওপরে উঠল। কিন্তু যেই জিজ্ঞাসা করা হল, ‘কার কার বাড়িতে ব্যবহার করার মতো শৌচাগার আছে’, বহু হাতই চটজলদি নেমে গেল। এমন অভিজ্ঞতা শুধু সুন্দরবন নয়, খাস কলকাতার মধ্যেও অনেক এলাকায়। শৌচাগার নেই, মাঠঘাট, নর্দমাই ভরসা, কিন্তু ঘরে কেব্ল লাইন, পকেটে মাল্টিমিডিয়া মোবাইল।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে। যে পরিবার নিয়মিত টাকা খরচ করে মোবাইল টেলিফোন ব্যবহার করে বা টিভিতে স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখে, তারা শৌচাগারের জল বা পানীয় জলের জন্য সামান্য খরচ করতে রাজি হবে না? বিশেষত যদি পরিষেবার মান ঠিকঠাক হয়? দেবীপুরের বন্দোবস্তটি করতে প্রায় দেড় লাখ টাকা লেগেছে। বেশি সংখ্যায় হলে খরচটা লাখখানেকে নেমে যাবে। অর্থাত্‌, শ’খানেক স্কুলের জন্য এক কোটি টাকার মতো পড়ে।

খরচটা খুব বেশি কি? একটা হিসেব দেওয়া যাক। সুন্দরবন অঞ্চলে মোটামুটি তিনটে লোকসভা কেন্দ্র: জয়নগর, বসিরহাট, মথুরাপুর। তিনটি কেন্দ্রের নির্বাচিত লোকসভা সদস্যরা তাঁদের পাঁচ বছরের মেয়াদে এক এক জন উন্নয়নের জন্য পঁচিশ কোটি টাকা পান এবং আগামী দিনে পাবেন। এই দাবি কি খুব অসঙ্গত হবে, যদি ভোট চাইতে আসা প্রার্থীদের এই অর্থের এক সামান্য অংশ স্থানীয় স্কুলগুলিতে শৌচাগারে জল সরবরাহের জন্য খরচ করতে বলা হয়? কেবল সুন্দরবনে নয়, এই রাজ্যের সর্বত্রই?

তা না হলে আবার কখন দেবীপুরের মতো অন্য কোথাও কোনও স্কুলে এমন ব্যবস্থা চালু করে উত্‌সব করা হবে, আর নির্বাচনী নিষেধাজ্ঞা না থাকলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাইকে বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ নাগরিক হতে বলবেন।

jayanta basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy