Advertisement
E-Paper

স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া

মূর্তিই হোক বা অন্য কোনও ভাস্কর্য, শহর সাজাতে আজও আমরা কোনও মৌলিকতা দেখাতে পারিনি।উমা সিদ্ধান্ত তখন সদ্য আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। ১৯৫৭ সাল। হাজরা পার্কে (আজকের যতীন দাস পার্ক) বসল তাঁর ভাস্কর্য ‘মা ও শিশু’। দশ ফুটের এই সিমেন্টের ভাস্কর্যটিই কলকাতায় প্রথম প্রকাশ্য জায়গায় বসানো এ ধরনের শিল্পকর্ম।

ইন্দ্রজিত্‌ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
বিধাননগরে বিদ্যুত্‌ ভবনের সামনে রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’ (কপি)।

বিধাননগরে বিদ্যুত্‌ ভবনের সামনে রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’ (কপি)।

উমা সিদ্ধান্ত তখন সদ্য আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। ১৯৫৭ সাল। হাজরা পার্কে (আজকের যতীন দাস পার্ক) বসল তাঁর ভাস্কর্য ‘মা ও শিশু’। দশ ফুটের এই সিমেন্টের ভাস্কর্যটিই কলকাতায় প্রথম প্রকাশ্য জায়গায় বসানো এ ধরনের শিল্পকর্ম। তার আগে দেড়শো বছর ধরে শহরের পথে-ঘাটে-ময়দানে যা বসেছে তার প্রায় সবই মূর্তি, না হলে ব্যক্তি-স্মারক। কাজি আবদুল ওদুদ কী যে সত্যি কথা বলেছিলেন, সেই (মূর্তি বসানোর) ট্র্যাডিশন থেকে আমরা আর কিছুতেই বেরোতে পারিনি।

উপনিবেশের রাজধানী শহরের পক্ষে মূর্তি দিয়ে শহর সাজানো আদৌ অস্বাভাবিক ছিল না। ১৮০৩-এ কর্নওয়ালিসের মূর্তি দিয়ে শুরু, স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কলকাতায় সাহেবদের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি বসেছে গোটা চল্লিশ। এর পিছনে রাজভক্ত বাঙালিদেরও যথেষ্ট অর্থানুকূল্য ছিল। পাশাপাশি অবশ্য রমানাথ ঠাকুর থেকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, জনা দশেক ভারতীয় ব্যক্তিত্বের মূর্তিও বসানো হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর এক দিকে যেমন শহর থেকে সাহেবদের মূর্তি তাড়ানো শুরু হল, তেমনই পাল্লা দিয়ে বসতে লাগল নতুন নতুন মূর্তি। এ ক্ষেত্রে ছ’দশকেই আমরা সাহেবদের হারিয়ে দিয়েছি। অনায়াসে শহরের ফাঁকে-ফোকরে যেখানে সেখানে গুঁজে দিতে পেরেছি অন্তত পঞ্চাশটা মূর্তি। আর ছোটখাটো মূর্তি ধরলে এই সংখ্যাটা যে কোথায় পৌঁছবে কে জানে!

কোথায়, কেন, কী মূর্তি বসবে, এ সব হাবিজাবি ভাবনা সাহেবরা ভাবতে পারে, আমরা ও সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। সাহেবদের মূর্তি সরানোর সময় কমল সরকার কার্টুন এঁকেছিলেন, কোনও অশ্বারোহী সাহেবের মূর্তির ঘোড়াটা রয়েছে, মূর্তি বেপাত্তা। অস্যার্থ, ঘোড়াটা ভারতীয়, তাই রেখে দেওয়া হয়েছে। সত্যিই তো, আমরা ভিক্টোরিয়ার সামনে কার্জনের মূর্তির জায়গায় শ্রীঅরবিন্দকে এনেছি, কিন্তু বেদির চারপাশে শান্তি, বাণিজ্য, কৃষি ও দুর্ভিক্ষত্রাণ-এর অঙ্গমূর্তিগুলি সরাইনি। বাবুঘাটে সুউচ্চ বেদির উপর পঞ্চম জর্জকে স্থানচ্যুত করেছেন বঙ্কিম, আদৌ মানায়নি। ময়দানে জওহরলালের মূর্তির বেদি তুলনায় অনেক ছোট। সাম্প্রতিক দুটি উত্‌কট নমুনা, বউবাজার-চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ মোড়ের উত্তরে রানা প্রতাপের মূর্তি আর দক্ষিণে ছোট্ট জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে মুথুরামলিঙ্গ থেবর ও বল্লভভাই পটেল-এর মূর্তি। চার পাশে উঁচু উঁচু বাড়ি থাকলে মূর্তি কী দেখবেন? কোনও দিকে একটু আকাশ রাখব না, চারপাশে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়ব না, অথচ মূর্তি বসাতেই হবে।

ভারতেরই অন্যান্য মহানগরে তো এমন হয় না। সেখানে ‘আর্বান আর্টস কমিশন’ আছে, শহরের কোথায় কী মূর্তি বা ভাস্কর্য বসবে, কোনটা কোথা থেকে কোথায় সরানো হবে, সেটা তারাই ঠিক করে। কলকাতায় কোনও দিনই এমন কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি হয়নি। বাম জমানায় একবার ‘আর্বান আর্টস কমিশন’ তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আরও অনেক সদিচ্ছার মতোই তারও ঠাঁই হয়েছে ঠাণ্ডা ঘরে। কর্তৃত্ব থেকে গেছে পুরসভার হেরিটেজ কমিটি আর হেরিটেজ কমিশনের উপর, যেখানে সরকারের ইচ্ছেই শেষ কথা।


যতীন দাস পার্কে উমা সিদ্ধান্তর
‘মা ও শিশু’, এখন নিশ্চিহ্ন।

মূর্তির বাইরে এ শহরে কখনও একেবারে কিছু ভাবা হয়নি তা নয়। কিন্তু তার অধিকাংশই আমরা টিকিয়ে রাখতে পারিনি। উনিশ শতকেই তো কালীপ্রসন্ন সিংহ দুটো চমত্‌কার ফোয়ারা বিদেশ থেকে আনিয়ে এ শহরে বসিয়েছিলেন, তাঁর বাড়ির কাছে বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে। তার ভোল পাল্টে গেছে অনেক দিন। পাখিদের জন্য ঢালাই লোহার কারুকার্য করা জলসত্র ছিল ময়দানে, ডেসমন্ড ডয়েগের ছবিতেই শুধু তা বেঁচে আছে এখনও। ভাইসরয়ের সহকারী একান্ত সচিব দিমিত্রিয়স পানিয়োতি-র স্মৃতিতে কার্জন পার্কে বসানো মর্মর-স্মৃতিসৌধ ‘পানিয়োতি ফাউন্টেন’-এর ফোয়ারা বহু দিন উধাও। প্রিন্স অফ ওয়েলস-এর সফর উপলক্ষে ঢাকার নবাব আসানুল্লা যে দুটি স্মারক তৈরি করেন, তার মধ্যে ধর্মতলা মোড়েরটি ট্রামের ধাক্কায় ভাঙার পর খুব খারাপ ভাবে সংস্কার হয়েছে, আর কয়লাঘাটেরটি চায়ের দোকানে ঢাকা পড়েছে।

স্বাধীনতার পরে অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। উমা সিদ্ধান্তের যে ভাস্কর্যের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, মেট্রো রেলের কাজের সময় ক্রেন পড়ে গিয়ে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। ময়দানের জলসত্রটিও উধাও হয় মেট্রোর কাজের সময়। এ ধরনের শিল্পকর্ম বসানোর দিকে সরকারেরও যেমন কোনও দিনই উত্‌সাহ দেখা যায়নি, শহরের শিল্পীরাও কি কখনও উদ্যোগী হয়েছেন বড় মাপের এমন কোনও কাজ শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসাতে? রামকিঙ্কর তীব্র সমালোচনা করলেও নানা রকম বেঢপ মূর্তি তৈরি করেই তাঁরা সন্তুষ্ট থেকেছেন। ছোটখাটো ইনস্টলেশন যা হয়েছে, তার প্রতি কারও কোনও দরদ ছিল বলে মনে হয় না। বেকবাগান মোড়ে অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইনস্টলেশন, পার্ক স্ট্রিট-ক্যামাক স্ট্রিট মোড়ে তাপস সরকারের ‘স্বপ্নপুতুল ও একটি পরিবার’, ফুলবাগান মোড়ে তপন করের ভাস্কর্য, মৌলালি যুবকেন্দ্রে বিজন চৌধুরীর বিশাল মুরাল, উল্টোডাঙা থেকে বিধাননগরে ঢোকার মুখে গাছ থেকে গুলতি দিয়ে আম পাড়ায় ব্যস্ত দুটি শিশুর ভাস্কর্য নিশ্চিহ্ন করে ফেলা এবং সম্প্রতি বাইপাসে পরমা আইল্যান্ডে শানু লাহিড়ীর করা লোকায়ত বাংলার প্রতীকটি সরাতে গিয়ে ‘অনবধানতা’য় ভেঙে ফেলা একই মানসিকতার ধারাবাহিক চিত্র। বিধাননগরে বিদ্যুত্‌ ভবনের সামনে রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’-এর কপি বসানো হয়েছে, ভালই হয়েছে, কিন্তু মৌলিক ভাস্কর্য করার শিল্পীর কি অভাব পড়েছে?

প্রশ্নটা শিল্পকর্মের মান নিয়ে নয়। যে সব ভাস্কর্য নষ্ট করা হয়েছে, তার ‘মান’ খারাপ হলে বসানোর যুক্তি কী? এক বার বসানোর পর যদি সরাতে হয়, তা হলে একদম ভেঙে ফেলতে হবে? এ সব তো ছোটখাটো বিষয়। বড় মাপের যা কাজ হচ্ছে, তাতে তো নিজস্বতার কোনও চিহ্ন নেই। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজির অশ্বারোহী মূর্তি তৈরির আগে মরাঠি শিল্পী নাগেশ যবলকরকে উটরামের বিখ্যাত অশ্বারোহী মূর্তির ছবি দেওয়া হয়েছিল। তার ফল যা হয়েছে সবাই জানেন। না জানলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে গিয়ে উটরামের মূর্তিটা দেখে নিতে পারেন, খুব সহজেই বুঝে যাবেন। সাহেবদের মূর্তি শহরে প্রকাশ্যে রাখব না, কিন্তু কুত্‌সিত অনুকরণে অসুুবিধা নেই। আর এখন তো কলকাতা লন্ডন হয়ে যাচ্ছে, গঙ্গার ধারে ‘লন্ডন আই’-এর ধাঁচে ‘কলকাতা আই’, লেকটাউন ভি আই পি মোড়ে ‘বিগ বেন’... আরও কত কী হবে। সাহেবরা ভুল করে এটাকেই না ‘হোম’ ভেবে বসে!

না, ভুল হল। কূপমণ্ডূক বাঙালিই তো এ বার বিশ্বায়িত হয়ে যাচ্ছে। পরমা আইল্যান্ডে এখন বসবে ‘ব’ মার্কা ভূগোলক, বিশ্ববঙ্গের প্রতীক। সত্যিই তো, বাঙালির যাবতীয় মৌলিকতা এখন এসে ঠেকেছে বাংলা অক্ষরে। পৃথিবীর গায়ে খুব বড় করে ‘ব’ না লিখলে আর বাঙালি বলে নিজেদের চেনানোর কোনও উপায় নেই।

post editorial indrajeet choudhury indrajit choudhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy